সত্তরের ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার পরে ব্রাজিল টিম থেকে কি বাদ পড়তে পারতেন জর্জিনহো? কিংবা ছিয়ানব্বইয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পরে শ্রীলঙ্কা টিমের বাইরে রাখা যেত সনৎ জয়সূর্যকে?
এমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ঘটলে তা যতটা অবিশ্বাস্য হত, সে-দিন তার চেয়ে কম বিস্ময়কর কিছু শুনতে হয়নি শৈলজা টিচারকে। একে তো কান্নুর জেলার মাত্তান্নুর কেন্দ্রে নিজে জিতেছেন ৬১ হাজারের ব্যবধানে, ভোট পেয়েছেন প্রায় ৬২%। যা কেরলের বিধানসভা নির্বাচনের ইতিহাসে রেকর্ড। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণী এই রাজ্যে বহু বছরের রেওয়াজ ভেঙে পর পর দু’বার ক্ষমতায় আসার নজির গড়েছে এলডিএফ। এবং এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, কোভিড মোকাবিলায় সাফল্যই বাম সরকারকে এই শিরোপা তুলে দিয়েছে। নানা মহলে জল্পনা চলেছে, অতিমারির সঙ্গে লড়াইয়ে বিপুল ভাবে প্রশংসিত ‘রকস্টার হেলথ মিনিস্টার’ শৈলজা এ বার নিশ্চয়ই উপমুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। এই রকম একটা গণ-প্রত্যাশার আবহে তিরুঅনন্তপুরমে দলের রাজ্য দফতর এ কে জি সেন্টারে ধীর পায়ে ঢুকেছিলেন ‘টিচার’। কিছু ক্ষণ বাদে শুনলেন, পদোন্নতি দূর অস্ত্, তালিকায় তাঁর নামই নেই! মুখ্যমন্ত্রী বাদে গোটা মন্ত্রিসভাই আগাগোড়া বদলে দিয়ে নতুন মুখ আনা হচ্ছে। সহকর্মীরাও স্তম্ভিত। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে চার জন এবং রাজ্য কমিটিতে জনাদশেক সওয়াল করেছিলেন ‘টিচার’কে রেখে দেওয়ার জন্য, তবে পার্টির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নিয়ে কেউ ভোটাভুটি চাননি।
বাইরে খবর বেরোতেই বিশ্বসুদ্ধ সবাই জানতে চেয়েছে, কোভিড-যুদ্ধের যে সেনাপতির দক্ষতার কথা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত হয়েছে, তাঁর পুরস্কার মন্ত্রিত্ব হারানো? শৈলজা কিন্তু বিচলিত নন। যে যখন যে ভাবে জানতে চেয়েছে, সকলকেই তাঁর সহজ এবং স্পষ্ট জবাব: “আমিও তো পাঁচ বছর আগে মন্ত্রিত্বে নতুন ছিলাম। দল একটা দায়িত্ব দিয়েছিল, সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করেছি। নতুনদেরও একই ভাবে সুযোগ দিতে হবে, তাঁরা আরও ভাল কাজ করবেন।” কিন্তু নিজের অনুভূতি? সে-বিষয়েও তাঁর একটাই কথা, “ব্যক্তি বড় কথা নয়। কাজ করে সিস্টেম। সিদ্ধান্ত হয় নীতির উপরে দাঁড়িয়ে, একা মন্ত্রী বা ব্যক্তির উপরে নির্ভর করে নয়।” করোনা মোকাবিলার কাজও সেই ‘সিস্টেম’ মেনেই চলবে— সদ্য-প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশাবাদী নন, নিশ্চিত।
সিস্টেম নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাই বলে কি ব্যক্তির ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করা চলে? বিশেষ করে ব্যক্তির নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমকে? পাঁচ বছরে একের পর এক মারণ রোগ মোকাবিলায় টিচার পরিশ্রম কম করেননি। মালয়ালি সমাজে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ‘মাস্টার’ এবং শিক্ষিকাদের জন্য ‘টিচার’ কথাটা নামের সঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এর আগে ভি এস অচ্যুতানন্দনের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী পি কে শ্রীমতিকেও বলা হত ‘শ্রীমতি টিচার’। নিপা, করোনা— ভাইরাস-অসুরদের সঙ্গে শ্রীমতির উত্তরসূরির যুদ্ধ এতটাই সমাদৃত হয়েছে যে, লোকের মুখে মুখে তিনি হয়ে গিয়েছেন শুধুই ‘টিচার’। ‘নিপা’ মোকাবিলায় সাফল্যের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃতি দিয়েছে, বিদেশে গিয়ে পুরস্কার নিয়ে এসেছেন। মালয়ালম চলচ্চিত্র শিল্প তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে তৈরি করেছে ভাইরাস ছবিটি, যেখানে টিচারের ছায়ায় নির্মিত চরিত্রে রেবতী।
কী ভাবে শুরু হয়েছিল ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি, টিচারের কাছেই শুনেছিলাম এক বার, মুখোমুখি বসে। ডাক্তার তো নন। তা হলে স্বাস্থ্যে এত উৎসাহ? বায়োলজি পড়াতেন? তিরুঅনন্তপুরমের স্বাস্থ্যমঙ্গলম-এ সচিবালয়ের আটতলায় নিজের দফতরে বসে সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং মহিলা সমিতির নেত্রী বলেছিলেন, “না, না! কান্নুরের শিবপুরম হাইস্কুলে কেমিস্ট্রি পড়াতাম। পার্টি যখন বলল, চাকরি ছেড়ে ফুল টাইম কাজ করতে হবে, ছেড়ে দিয়েছি পড়ানো। ২০১৬ সালে প্রথম বার মন্ত্রী হয়ে স্বাস্থ্য দফতর পেয়ে নার্ভাস ছিলাম! পিনারাই সাহস দিয়েছিলেন।” শৈলজার মুখেই শোনা, প্রথম বার ‘নিপা’র হানায় মৃত্যুর সংখ্যা যখন বেড়ে চলেছে, রাতে ঘুম আসত না। মনে হত, সরকারের কাজ তো শ্মশানযাত্রী হওয়া নয়! মোকাবিলার রাস্তা বার করতেই হবে। আমলারা বলেন, তার পর থেকেই ম্যাডামের নাকি ইস্পাতের স্নায়ু! এবং অদম্য কর্মক্ষমতা। গোটা কোভিড পর্বে একটানা দেখেছেন তাঁরা— মন্ত্রী নিজে সমস্ত খুঁটিনাটি খবর রাখেন, মাঝরাত পর্যন্ত অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আবার পরের দিন ঠিক সকাল সাতটায় ফোন করে জানতে চান, ‘হোপ, এভরিথিং ইজ় ফাইন’? করোনায় লড়ে যান আরআরটি (র্যাপিড রেসপন্স টিম) নিয়ে।
স্বাভাবিক ভাবেই তাই নতুন মন্ত্রিসভার খবর প্রকাশের পর থেকেই পার্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মুখ বদলানোর নীতিতে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে অন্তত স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কি রেখে দেওয়া যেত না? মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন জবাব দিয়েছেন, “উনি শুধু নন, গোটা মন্ত্রিসভা ভাল কাজ করেছে বলেই মানুষ আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ব্যতিক্রম এক জনের জন্য ঘটালে অন্যেরাও দাবিদার হতেন। কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে প্রার্থীই করা হয়নি। নতুনদের এগিয়ে দেব, এই নীতিটাই সামনে রাখতে চাই।” তবু প্রশ্ন থেকে যায়। আর তার ভিতরে থাকে গূঢ়তর জিজ্ঞাসা: শৈলজা পুরুষ হলেও কি একই সিদ্ধান্ত হত? না কি, তখন তিনি হতেন বন্দিত ব্যতিক্রম?
কলকাতায় অবশ্য অন্য গোত্রের প্রশ্ন ওঠে। মন্ত্রী এবং পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হলে শোরগোল ওঠে: করোনা মোকাবিলার কী হবে? এবং তার জবাবে কেউ বলে না: ব্যক্তি কিছু নয়, কাজ তো করে সিস্টেম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy