শেষ পর্যন্ত চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই পরিচয় দিলেন বঙ্গবাসী। নিম্নচাপের মেঘ সরিতেই রাজপথে মানুষের ঢল নামিল, মণ্ডপের বাহিরে ভিড় জমিল। ভাবখানা এমন, যেন কোভিডে প্রাণ যদি যায়, যাউক, পূজার আনন্দ কোনও ভাবেই হাতছাড়া করা চলিবে না। যে জনগোষ্ঠীর কাণ্ডজ্ঞানের এহেন নমুনা, তাহাকে বাঁচাইবে কে? অবশ্য প্রশ্ন উঠিবে, যাঁহারা রাজ্যের মানুষের অভিভাবকসম, সেই নেতারাই বা দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিলেন কোথায়? ঘটনাক্রমে, তাঁহাদের অনেকেই কলিকাতার বিপুল জনপ্রিয় কিছু পূজার হর্তাকর্তা। হাই কোর্ট যখন নির্দেশ দিল যে, মণ্ডপের দশ মিটারের মধ্যে কোনও দর্শনার্থীকে ঢুকিতে দেওয়া যাইবে না, এই কর্তাদের মধ্যে কার্যত এক জনও প্রকাশ্যে বলিলেন না যে, আদালতের রায় শিরোধার্য, দর্শনার্থীরা এই বৎসর না আসিলেই মঙ্গল। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ ভাবে না হইলেও, তাঁহারা রাজ্যের আমুদে জনগণকে বুঝাইয়া দিলেন, কোভিডের ভীতি বা আদালতের উদ্বেগ, কিছুকেই আনন্দের পথে বাধা হইতে দিবার প্রয়োজন নাই। নেতারা হয়তো ভয় পাইয়াছেন, পূজায় লোককে আনন্দ করিতে বাধা দিলে পাছে ভোটাররা অসন্তুষ্ট হন; পাছে বিরোধী দল তাঁহাদের হিন্দু-বিরোধী’ বলিয়া দাগাইয়া দেন। ফলে, বিপদের মাপ এবং রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, উভয় বিষয়েই সম্পূর্ণ অবগত হইয়াও তাঁহারা ক্ষুদ্র স্বার্থপ্রসূত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিলেন না। অষ্টমী-নবমীতে রাস্তায় যে মানুষের ঢল নামিল, তাহার দায় এই নেতারা এড়াইবেন কী ভাবে?
যে পূজাকর্তারা এমন বড় মাপের নেতা নহেন, তাঁহারাও একই দোষে দুষ্ট। তাঁহারা বিলক্ষণ জানিতেন, এই পূজায় লোকসমাগম হইলে অতিমারির বিস্ফোরণ ঘটিবার প্রবল সম্ভাবনা, এবং সেই ধাক্কা সামাল দিবার জোর পশ্চিমবঙ্গের নাই। কাজেই, এই বৎসর নামমাত্র পূজায় কাজ সারিয়া ফেলা তাঁহাদের দায়িত্ব ছিল। তাঁহারা সেই পথে হাঁটেন নাই। কারণ, বারোয়ারি দুর্গাপূজা এখন এক বিপুল বাণিজ্য। বিজ্ঞাপন হইতে, স্টল ভাড়া হইতে, বড় মাপের চাঁদা হইতে নামকরা পূজাগুলি যে পরিমাণ টাকা সাধারণত তুলিয়া থাকে, তাহাতে চোখ ধাঁধাইয়া যাওয়া স্বাভাবিক। অনুমান করা চলে, পূজাকমিটির কর্তারা সেই যকের ধন হাতছাড়া করিতে চাহেন নাই। দুর্ভাগ্য, যাঁহাদের নিকট দায়িত্ববোধ প্রত্যাশিত ছিল, তাঁহাদের কেহ এই বৎসরটিতেও ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি অতিক্রম করিতে পারিলেন না। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, কিছুই তাঁহাদের নিকট ভোট বা টাকার অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইল না।
অবশ্য, যাঁহাদের নিকট চার দিনের আনন্দের তুলনায় নিজেদের প্রাণও তুচ্ছ, তাঁহাদের রক্ষা করা দুষ্কর। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আরও এক বার বুঝাইয়া দিলেন, তাঁহারা এখনও প্রজা থাকিয়া গিয়াছেন, নাগরিক হইবার অধিকার অর্জন করিতে পারেন নাই। নাগরিককে নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হইতে হয়। কোনটি কর্তব্য আর কোনটি নহে, তাহা বুঝিতে হয়। যে ব্যাধির প্রকোপে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত, তাহাকে প্রতিহত করিবার দায়িত্বটি যে নাগরিকের উপরও সমান ভাবে বর্তায়, পশ্চিমবঙ্গের প্রজারা সেই কথাটি বুঝিতে নারাজ। চার দিনের আনন্দের হাতছানিতে যাঁহারা আত্মহারা হইয়া পথে নামিলেন, তাঁহারা যে শুধু নিজেদের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত করিলেন, তাহা নহে— যে নাগরিকরা এই কয়দিন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকিলেন, তাঁহাদেরও বিপন্ন করিলেন; যে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করিয়া কোভিডের বিরুদ্ধে লড়িতেছেন, তাঁহাদের বোঝা আরও বাড়াইলেন। কোন সামাজিক মূল্যে তাঁহারা চার দিনের আনন্দ কিনিলেন, তাঁহারা ভাবিয়া দেখুন। লজ্জিত হউন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy