রক্তদান শিবির। বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। নিজস্ব চিত্র
খণ্ডচিত্র ১: দক্ষিণ বাঁকুড়ার একটি জঙ্গল ঘেরা গ্রামে চলছে রক্তদান শিবির। মেরেকেটে ২০টি ঘরের বাস এখানে। সেখানে রক্ত দিতে এসেছিলেন এক আদিবাসী রমণী। কিন্তু রক্তদানের আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় দেখা গেল, তাঁর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কম। ওজন কম হওয়ায় তাঁর রক্ত নিতে পারবেন না বলে জানালেন শিবিরের আয়োজকেরা। কিন্তু তাঁদের অবাক করে দিয়ে ওই বধূ তাঁর স্বামীর উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘‘তুই যা না কেনে? আমার তো রক্ত লিবেক নাই বলছে। তুই দিয়ে আয়।’’
খণ্ডচিত্র ২: প্রেমিকের সঙ্গে কলেজ থেকে ফিরছিলেন এক তরুণী। তরুণীর মুখ গম্ভীর। কারণ, প্রেমিক এবং তার বন্ধুদের ঠাট্টার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। সে দিন তিনি কলেজে আয়োজিত রক্তদান শিবিরে রক্ত দিয়েছেন। দেবেন না-ই বা কেন? তাঁর বয়স আঠারো পেরিয়েছে। তিনি সুস্থ। তার শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ পর্যাপ্ত। ওজনও স্বাভাবিক। রক্তদান করার জন্য সব দিক থেকে তিনি উপযুক্ত। তা ছাড়া, কত মানুষই তো সময়কালে রক্ত না পেয়ে মারা যান। কী হয় শরীরের খানিক রক্ত প্রয়োজনে দান করলে!
কিন্তু তরুণীর মনের এই সাধারণ কথা তাঁর প্রেমিকের মাথায় ঢোকে না। তিনি বলেন, ‘‘রক্তদান করলে তোমার শরীরের জৌলুস কমে যাবে। সেটা কি তুমি চাও?’’
হতভম্ব হয়ে যান মেয়েটি। সেই তরুণের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি তাঁর। আজ তরুণী একটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংস্থার নিয়মিত সদস্য।
এই দুই খণ্ডচিত্র দুই মেরুর। আমাদের রাজ্যে এখনও যথা সময়ে পর্যাপ্ত রক্ত না মেলার কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে সচেতনতার প্রচার করা হলেও সব ক্ষেত্রে যে সাফল্য মেলে এমনটা নয়। বিরল গ্রুপের রক্ত হলে সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।
তা-ও রক্তদান নিয়ে অনেক মানুষের মনেই দ্বন্দ্ব রয়ে যায়। অনেকেই মনে করেন, মেয়েদের রক্তদান করা উচিত নয়। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে ভারতীয় মহিলাদের একটি বড় অংশ রক্তাল্পতা এবং অপুষ্টির শিকার। সেই কারণে তাঁদের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া যায় না। কিন্তু কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা যদি সব দিক থেকে সুস্থ থাকেন, তিনি অবশ্যই রক্তদান করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয় না। জৌলুস কমে যাওয়ার বিষয়টিও মনগড়া।
অনেকেই মনে করেন, রোগা মানুষেরা রক্তদানের উপযোগী নয়। মোটা মানুষের শরীরে বেশি রক্ত থাকে। বাস্তব এমন নয়। নির্দিষ্ট ওজন থাকলেই রক্ত দেওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, রক্তদান করতে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু মাত্র ১০-১২ মিনিটেই রক্তদান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে যায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই রক্ত দিতে পারেন। রক্তদানের এক দিনের মধ্যেই রক্তদাতা খেলাধুলো করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্যহানি হয় না।
যাঁরা স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, গ্রীষ্ম কালে এমনিতেই রক্তদান শিবির কম আয়োজিত হওয়ায় ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে রক্তের ঘাটতি পড়ে। তার উপর চলতি বছরে ভোটপর্ব চলায় সেই খরা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। সে ঘাটতি পূরণ করতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি, এগিয়ে এসেছেন চিকিৎসক এবং নার্সেরা। গত শুক্রবারই যেমন পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে নার্স এবং ডাক্তারেরা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। হাসপাতালে রক্তের ঘাটতি পূরণে উদ্যোগী হয়েছেন পুলিশও। থানায়-থানায় আয়োজিত হয়েছে রক্তদান শিবির।
আশার কথা, আজকাল সামাজিক সচেতনতা ক্রমে বাড়ছে। কেউ কেউ ছেলের অন্নপ্রাশনে, মেয়ের বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছেন। সাম্প্রতিক কালে এমন উদাহরণ বাঁকুড়া জেলায় বেশ কয়েকটি রয়েছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হলে খরচ বাঁচে। অনেক মানুষের সমাগম হয়। রক্তদাতার পরিমাণ বাড়ে এবং রক্তদানও হয়ে ওঠে উৎসবের অঙ্গ। যাঁরা রক্তের জন্য হাসপাতালগুলিতে রক্তের হাহাকার দেখেছেন তাঁরা জানেন রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা।
দীর্ঘদিন থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা নিয়ে কাজ করছেন এমন এক সমাজকর্মীর মতে, রক্তদান সম্পর্কে মানুষ ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছেন। বাড়ছে রক্তদাতা। কিন্তু এই সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তাঁর দাবি, এখনও বহু স্কুলে রক্তদান নিয়ে সচেতনতা প্রচারের শিবির করতে দেওয়া হয় না। শিশুরা রক্তদান করতে পারে না, এই যুক্তিতে। কিন্তু এই শিশুরাই তো সমাজের ভবিষ্যৎ! তারা রক্তদানের গুরুত্ব না বুঝলে ভবিষ্যতে কী হবে? পাঠ্যক্রমে রক্তদান বিষয়টিকে যোগ করলেও উপকার হতে পারে। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যেও যদি রক্তদানে সচেতনতা আনা যায় তা হলে রক্তদাতার সংখ্যাটা আরও অনেকটাই বাড়ানো যাবে। বাড়ির মা যদি তাঁর সন্তানকে বলেন, ‘‘যা গিয়ে রক্ত দিয়ে আয়...’’ বা স্ত্রী যদি স্বামীকে বলেন, ‘‘যাও, রক্ত দিয়ে এস...’’ তা হলে অন্তত এক দিন আর রক্তসঙ্কটে ভুগতে হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy