Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Death

অপর-এর মৃত্যু

ঘটনাটিতে আতঙ্ক জাগে। কিন্তু, ইহা কি নিতান্তই অপ্রত্যাশিত? বলিলে অনৃতভাষণ হইবে।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

বারাসতে এক চব্বিশ বৎসর বয়সি যুবকের দেহের সহিত আরও একটি জিনিস মাটিতে মিশিয়া গেল— তাহার নাম মানবিকতা। মানবিকতার অস্তিত্ব যে ক্রমেই বিপন্ন, সেই ইঙ্গিত হরহামেশা মিলে। কিন্তু বারাসতের ঘটনাটি দেখাইয়া দিল, সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইতে তাহার আর অধিক সময় নাই। সেখানে মধ্যরাতের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাইক-আরোহীকে দেখিয়াও কেহ সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দেয় নাই, ইহা এখন ‘স্বাভাবিক ঘটনা’। বারাসতের অস্বাভাবিকত্ব হইল, অন্তত পঞ্চাশটি গাড়ি যুবকের দেহের উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছে। দেহাংশের প্রায় কিছুই উদ্ধার করা যায় নাই। যাহা উদ্ধার হইয়াছে, তাহা হইল এক অসংবেদনশীল বীভৎস পৃথিবীর প্রকৃত রূপ।

ঘটনাটিতে আতঙ্ক জাগে। কিন্তু, ইহা কি নিতান্তই অপ্রত্যাশিত? বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। প্রাত্যহিক অমানবিকতার দৃষ্টান্তগুলিকে এক সূত্রে গাঁথিয়া লইলেই বোঝা যাইবে, বারাসতে যাহা হইয়াছে, তাহা হওয়ারই ছিল। আহতকে রাস্তায় পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া হাসপাতালে লইয়া যাইবার পরিবর্তে যাঁহাদের হাতে মোবাইল ক্যামেরা খুলিয়া যায়, জনবহুল রাস্তায় তরুণীকে শ্লীলতাহানির শিকার হইতে দেখিলেও যে জনতার মুখে একটি প্রতিবাদবাক্যও শুনা যায় না, তাঁহাদেরই একাংশ যে সুযোগ পাইলে আরও কিছুটা বেপরোয়া হইবেন, বিপন্নকে এড়াইয়া যাইতে যাইতে যে এক দিন চরম উপেক্ষায় তাঁহাকে পদদলিত করিয়া চলিয়া যাইবেন, তাহাতে বীভৎসতা আছে, অপ্রত্যাশিত উপাদান নাই। যাঁহারা এই সারসত্যটি বুঝেন নাই, তাঁহারা অনর্থক আশাবাদী। সত্য যে, বিপন্নকে সাহায্য করিবার ধর্মটি সকলে সমান ভাবে পালন করেন না। বিপদ দেখিলে সর্বদাই জনতার একাংশ নিজেকে সুরক্ষিত করিতে অধিক ব্যস্ত হইয়া পড়েন। এই মনোভাবে কাপুরুষতা প্রকট। কিন্তু বিপন্নকে উদ্ধার করিবার পরিবর্তে তাঁহার শরীরের উপর দিয়া গাড়ি চালাইয়া যাইবার মধ্যে একটি সীমা উল্লঙ্ঘন আছে— বর্বরতার সীমা। আহতের প্রতি ঔদাসীন্য এক, তাঁহাকে সচেতন ভাবে আরও আঘাত করা আর এক। নাগরিক প্রথম ধাপ হইতে দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হইলেন।

কিসের অভাবে মনুষ্যত্বের এই প্রাথমিক শর্তটুকুও বিসর্জন দিলেন সেই রাত্রের গাড়িচালকেরা? সেই বিমূর্ত গুণটির নাম সমানুভূতি। অর্থাৎ, যে বিপদ বা যন্ত্রণা নিজের নহে, অন্য কাহাকে সেই বিপদে পীড়িত হইতে দেখিলে তাহার তীব্রতা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিবার গুণ। সমানুভূতির ক্ষমতাটি মানুষের এক দিনে লোপ পায় নাই। তাহা একটি প্রক্রিয়া। পারিপার্শ্বিক হইতে বিচ্ছিন্নতা, নিরন্তর আত্মমগ্নতা, অবিরত স্বার্থান্বেষণ— আধুনিক জীবনের এই চরিত্রলক্ষণগুলিই মানুষকে প্রথমে ‘অপর’ চিহ্নিত করিতে শিখাইয়াছে, এবং তাহার পর সেই ‘অপর’ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্বিষ্ট হইবার শিক্ষা দিয়াছে। যে মানুষটি গুরুতর আহত অবস্থায় পথে পড়িয়া আছেন, তাঁহাকে একটি পূর্ণ সমমানুষ হিসাবে কল্পনাই হয়তো করিতে পারেন নাই সে রাত্রের গাড়িচালকেরা। এই অক্ষমতা অবিশ্বাস্য, কিন্তু ইহাই বাস্তব। আমি কখনও এই রূপ বিপন্ন হইতে পারি কি না, তাহা বিচার্য নহে, মনুষ্য হিসাবেই এই মানুষটির পার্শ্বে আমার দাঁড়ানো প্রয়োজন, এই বোধটি ফিরাইয়া আনিতে আরও কত জন্মের সাধনা চাই, এখন তাহাও বুঝি কল্পনার অতীত।

অন্য বিষয়গুলি:

Death Accident Barasat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy