আলোয় আলোকময় এক ঐতিহাসিক বিচারের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে আর কয়েক মাস বাকি, কিন্তু তার আগেই হয়তো নেমে আসতে চলেছে ঘোর অন্ধকার। ১৯৭৩ সালের ২২ জানুয়ারি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল: দেশের সংবিধান অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে মান্য করে, রাষ্ট্র যাতে এই ব্যাপারে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ না করে, সে জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক রক্ষাকবচ জননীর প্রাপ্য। এই রায় হঠাৎ আসেনি, তার আগে অন্তত দু’দশক ধরে এই অধিকারের জন্য মেয়েদের দীর্ঘ লড়াই চালাতে হয়েছে, যে লড়াইয়ে শরিক হয়েছেন বহু সুচেতন পুরুষও। সেই কালান্তরের ফলে এক দিকে আইন-আদালতের পরিসরে বহু পরিবর্তন আসে, অন্য দিকে সামাজিক চেতনার স্তরেও বিপ্লব ঘটে যায়, যার প্রভাব পড়ে বিচারবিভাগ-সহ কার্যত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের চিন্তায় ও আচরণে। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৭৩-এর সেই ‘রো বনাম ওয়েড’ নামে প্রসিদ্ধ মামলার ফলটি কেবল আমেরিকা নয়, দুনিয়ার ইতিহাসে নারীর আপন ভাগ্য জয়ের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক উজ্জ্বল মুহূর্ত হিসাবে বন্দিত হয়ে এসেছে, সেই সংগ্রামকে নতুন শক্তি দিয়েছে।
আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট কি সেই রায়কে নাকচ করবে? বহু আন্দোলনের পরে বিচারবিভাগের সিদ্ধান্তে মেয়েরা আপন শরীরের উপর যে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলেন, আধিপত্যবিস্তারী রাষ্ট্রের তথা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গ্রাস থেকে স্বাধিকারকে বাঁচানোর যে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেয়েছিলেন, দত্তাপহারক আদালত তা এ বার কেড়ে নেবে? একটি মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি ‘ফাঁস হয়ে যাওয়া’ নথি এমন আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মামলাটির নিষ্পত্তি প্রত্যাশিত। আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। অনেক দিন ধরে আমেরিকায় কট্টর রক্ষণশীল, পশ্চাৎমুখী সামাজিক ধ্যানধারণা ক্রমাগত নিজের শক্তি বাড়িয়ে চলেছে, রাজনৈতিক পরিসরে উগ্র দক্ষিণপন্থী অতিজাতীয়তার অভিযানের সঙ্গে যা কেবল সমান্তরাল নয়, সমন্বিতও বটে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন তথা দলের নীতিতে সামাজিক প্রগতির ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যেটুকু উদ্যোগ হয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় এই উগ্র-রক্ষণশীলতা কী ভাবে বাড়তি ইন্ধন সংগ্রহ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের উৎকট মূর্তি তার বিশ্ব-কুখ্যাত প্রতীক।
ব্যক্তি-ট্রাম্প গৌণ। অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল— তাঁর উত্থানের পিছনে যে রাজনৈতিক শিবির এবং অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের বিরাট ভূমিকা ছিল, গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগেও তারা ভয়ানক রকমের সক্রিয়। রাঘববোয়াল প্রজাতির বিবিধ সংস্থা এবং ‘লবি’র বিপুল অর্থব্যয় ও প্রচার বিফল হয়নি— রিপাবলিকান জনপ্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় স্তরে এবং রাজ্যে রাজ্যে আইনসভায় এই উদ্যোগে তৎপর, তাদের শাসনাধীন রাজ্যগুলিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার আয়োজন চলছে অথবা সম্পন্ন হয়েছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের আমলে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে যে অস্বাভাবিক ও বিতর্কিত তৎপরতা দেখা গেছে, তার পিছনে আদালতে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের পাল্লা ভারী করার মতলব প্রবল ছিল। আজ যদি সুপ্রিম কোর্টে উল্টোরথের যাত্রা দেখা যায়, বুঝতে হবে সেই মতলব হাসিল হয়েছে। স্পষ্টতই, ডোনাল্ড ট্রাম্পরা গদি থেকে সরে গেলেও তাঁদের প্রভাব দুর্মর। বিশেষত, যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেই প্রভাব সঞ্চারিত হয়ে থাকে, তা হলে প্রশাসন বা আইনসভায় ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটলেও উল্টোরথের গতি রোধ করা যায় না। তাকে আবার অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কেবল আমেরিকায় নয়, যে কোনও দেশেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy