Advertisement
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Women

কাজের হাত

বিভিন্ন গবেষণায় ধরা পড়েছে, ভারতে মেয়েদের কর্মবিমুখতার অন্যতম কারণ পরিবারের অনুশাসন।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২২ ০৫:২৩
Share: Save:

জলবিন্দুতে যেমন সিন্ধুদর্শন হয়, তেমন রক্তবিন্দুতেও। রেণু খাতুনের কাটা-যাওয়া, রক্তাক্ত হাতটি দেখিয়ে দেয়, ভারতে মেয়েদের কাজে যোগদানের হার কেন এমন অস্বাভাবিক কম। কেন মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়লেও কাজে যোগদানের হার বাড়ে না। তা‌ই, এক জন মেয়ে নিজের পরিশ্রমে, দক্ষতায় কাজ করে স্বনির্ভর হতে চেয়েছে বলে স্বামী তার হাতটিই কেটে দিল— এ ঘটনার নৃশংসতা কেবল মনকে অবশ করে না, একটি বৃহৎ চিত্র মুহূর্তের মধ্যে উদ্ঘাটিত করে দেয়। বাংলা তথা ভারতের গার্হস্থের প্রকৃত রূপটি দেখিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি ঘরে ঘরে নিপীড়নের কারখানা হয়ে উঠেছে বলেই গার্হস্থ হিংসা, বধূনির্যাতন, বধূহত্যা আজ দৈনন্দিন সংবাদ। যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শিকড়টি প্রেম-ভালবাসায় সিঞ্চিত হওয়ার কথা, সেই প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে দাসশ্রমের কারবার। মেয়েরা তাদের শরীর-মন-বুদ্ধি-প্রশিক্ষণের সবটুকু পরিবারের পুরুষদের নির্দেশমতো নিয়োগ করবে, তাদের শ্রমার্জিত অর্থ তুলে দেবে পুরুষের হাতে, এই দাবি আজও বহাল। মেয়েদের স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, তাদের নিজস্ব সামাজিক পরিমণ্ডল থাকবে না— এমন প্রত্যাশাকে আজও স্বাভাবিক বলে মনে করে বাংলা তথা ভারতের যুবকরা। না, কেবল ব্যতিক্রমী বলে রেণু খাতুনের খবরটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাসখানেক আগে বহরমপুরের কলেজছাত্রী সুতপা চৌধুরীকে তার প্রাক্তন প্রেমিক কুপিয়ে খুন করেছিল, কারণ সুতপা তাকে প্রত্যাখ্যান করে ভিন্ন জীবন চেয়েছিল। একই ভাবে, নার্সের চাকরি কেতুগ্রামের রেণুকে স্বাধীন জীবন দিতে পারে, সেই আশঙ্কায় তাকে হত্যার চেষ্টা হল।

এই চূড়ান্ত নৃশংসতার ঘটনা প্রাত্যহিক না হলেও এদের বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা বলে দেখা অসম্ভব। কোভিড অতিমারিতে অন্তত দু’কোটি মেয়ে কাজ হারিয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রোজগারে ফিরে যায়নি। দারিদ্র বাড়ছে, বাড়ছে দৈনন্দিন জিনিসের মূল্য, তা সত্ত্বেও মেয়েদের একটি বড় অংশ নিয়ত কাজের সন্ধান করে ফিরছে না— এ ছবি কী বলে দেয়? ভারতে কর্মক্ষম বয়সের মেয়েদের পাঁচ জনের চার জনই কাজের বাজারে থাকে না, তার কারণ নিজস্ব রোজগার মেয়েদের কাছে স্বাধীনতার দরজা নয়। বরং নানা নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাইরের কাজ মেয়েদের উপর বাড়তি ঝুঁকি ও বোঝা। বিভিন্ন গবেষণায় ধরা পড়েছে, ভারতে মেয়েদের কর্মবিমুখতার অন্যতম কারণ পরিবারের অনুশাসন। অথচ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের হিসাব, পনেরো থেকে ঊনষাট বছর বয়সি মেয়েদের অর্ধেকও যদি যোগ দিত শ্রমের বাজারে, তা হলে দেশের মোট উৎপাদন নয় শতাংশ হারে বাড়ত। অর্থাৎ, ক্ষতি কেবল মেয়েদেরই নয়, ক্ষতি সকলের, ক্ষতি দেশের।

তাই রেণু খাতুনের স্বামীর নামের উপর ‘পুরুষতান্ত্রিক’ লেবেল সেঁটে দেওয়াটুকুই যথেষ্ট নয়। ভাবা দরকার, কেন বাংলার যুবকরা এখনও সঙ্গীকে সমান মর্যাদা দিতে পারে না? কেন তারা আজও মেয়েদের স্বাধীনতাকে পৌরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে দেখার প্রয়োজন অনুভব করে? তা কি পুরুষদের রোজগার ক্ষমতার অভাব, আয়ের সুযোগের অভাব, অথবা সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে ঘাটতি, না কি হিংস্র আধিপত্যের সার্বিক সংস্কৃতির প্রভাব? আজকের কিশোর, তরুণদের সম্মুখে পৌরুষের দৃষ্টান্ত কী এবং কেমন, যে এ-হেন ভয়ানক হিংস্রতা এত সহজেই পারিবারিক পরিসরে জায়গা পায়? অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া পুলিশ-আদালতের কাজ, কিন্তু এই প্রবল পরিব্যাপ্ত হিংসা, বিশেষত নারীহিংসা, প্রতিরোধের কাজটি কোনও প্রশাসন একা সাধন করতে পারবে না। এই কাজ সমাজের। কাজটি সহজসাধ্য নয়। কী ভাবে, কোন পথে সমাজ সে কাজ করতে পারে, তাও সহজবোধ্য নয়। কিন্তু এর কোনও কিছুই কাজটি না করার যুক্তি হতে পারে না। জাতির ভবিষ্যৎ জীবন নির্ভর করছে সমাজের ভূমিকার উপর।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Women Indian Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy