বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের প্রধানতম গুরুত্ব কী, সে প্রশ্নের উত্তরে সংবিধানের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে উত্তরটি রাজনৈতিক ভাবে শুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু তা রাজনৈতিকও হবে না, শুদ্ধও হবে না। তাঁর প্রধানতম গুরুত্ব, ভারতে ‘দলিত’ জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যা। সেই নিম্নবর্গের রাজনীতি আম্বেডকরের আদর্শ সম্বন্ধে আদৌ সচেতন কি না, অথবা সেই আদর্শকে আদৌ গুরুত্ব দেয় কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন। এবং, সচেতনতা ও গুরুত্বের অভাব কার্যত প্রশ্নাতীত, নচেৎ বহুজন সমাজ পার্টির মতো ঘোষিত ভাবে আম্বেডকরপন্থী দল নির্দ্বিধায় বিজেপির হাত ধরতে পারত না। কিন্তু, দলিত জনগোষ্ঠীর প্রশ্নাতীত প্রতীক হিসাবে বাবাসাহেব আম্বেডকরের গুরুত্ব অস্বীকার করার সাহসও কোনও দলের নেই। এমনকি, বিজেপিরও নয়, যাদের আদর্শগত পূর্বজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রাণপুরুষরা লিখিত ভাবেই বর্ণাশ্রমের প্রতি নিজেদের আদর্শ ঘোষণা করে গিয়েছেন, এবং দল হিসাবে বিজেপি আজ অবধি সেই অবস্থান থেকে নিজেদের তিলমাত্র দূরত্বের কথা কোথাও স্বীকার করেনি। আম্বেডকর সম্বন্ধে অমিত শাহের মন্তব্যটিই ভারতের বিরোধী রাজনীতির সামনে সুযোগ এনে দিয়েছিল আম্বেডকরের প্রশ্নে বিজেপির সুবিধাবাদী অবস্থানটির স্বরূপ জনসমক্ষে নিয়ে আসার। দুর্ভাগ্য, বিভিন্ন কুনাট্যে সুযোগটি এক রকম হাতছাড়া হল। আরও দুর্ভাগ্য, এমন একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও বিরোধীরা একটি সঙ্ঘবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এল দলীয় রাজনীতির বিবিধ ক্ষুদ্রস্বার্থসঞ্জাত বিভাজিকা।
ভারতে যে রাজ্যগুলির রাজনীতিতে প্রতীক হিসাবে আম্বেডকরের গুরুত্ব তুলনায় কম, পশ্চিমবঙ্গ তার একটি। তৃণমূল কংগ্রেস সম্ভবত রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষেই এই বিষয়টিকেও ইন্ডিয়া জোটের অভ্যন্তরে কংগ্রেসের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমানোর আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করেছে। তৃণমূল যে ভঙ্গিতে জোটের অবস্থান থেকে আংশিক সরে একক ভাবে অমিত শাহের মন্তব্যের বিরোধিতা করেছে, তাতে এক দিকে দায়রক্ষা হয়েছে, অন্য দিকে এটাও নিশ্চিত হয়েছে যে, এমনকি এই প্রশ্নেও ইন্ডিয়া জোটের অবস্থান সঙ্ঘবদ্ধ নয়। কিন্তু, জোটের অন্য যে শরিক দলগুলি একত্রে প্রতিবাদ করল, তাদের বয়ানও আশ্চর্য ভাবে ইতিহাস বিবর্জিত। কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেডকরের বিরোধের প্রসঙ্গটি বিজেপিই তুলেছে। দুর্ভাগ্য হল, হিন্দু কোড বিলের প্রশ্নে বিজেপির যে আম্বেডকরবাদী হওয়ার তিলমাত্র অবকাশ নেই, এই কথাটিও ইন্ডিয়া জোট সম্মিলিত কণ্ঠে স্পষ্ট ভাবে বলে উঠতে পারল না। নিতান্তই ইতিহাস-সচেতনতার অভাব, না কি কংগ্রেস যাতে কোনও ভাবে সুবিধা না পেয়ে যায়, তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা— সেই প্রশ্নের উত্তর জোটের নেতারা দিতে পারবেন।
মকর দ্বারে চড়ে বসে হল্লা করাকেই যাঁরা সংসদীয় রাজনীতির হদ্দমুদ্দ জ্ঞান করেন, তাঁদের কাছে ঐতিহাসিক প্রজ্ঞা প্রত্যাশা করা অর্থহীন। তবে, এই মুহূর্তটিকেই তাঁরা ব্যবহার করতে পারতেন এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলার জন্য— বিজেপি যে বৃহৎ হিন্দুত্বের কথা বলে, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আম্বেডকরের দর্শনকে অস্বীকার করার বৃহত্তম প্রচেষ্টা। কারণ, সেই বৃহৎ হিন্দুত্বের রাজনীতি বর্ণাশ্রমকে প্রশ্নমাত্র করে না, তাকে অনুসরণ করার ঐতিহাসিক অন্যায়টি সংশোধনের প্রচেষ্টার কথা না তোলাই ভাল। আজ নেহরুর সঙ্গে আম্বেডকরের বিতর্কের পাশাপাশি তাঁরা মনে করিয়ে দিতে পারতেন গান্ধীর সঙ্গে তাঁর তর্কের কথা— যেখানে পৃথক ইলেক্টরেটের দাবির সূত্র ধরে আম্বেডকর বর্ণহিন্দুদের থেকে দলিতদের স্বতন্ত্রতার কথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিজেপির পক্ষে আম্বেডকরকে আত্মসাৎ করা অসম্ভব— ইতিহাস সে পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু, সেই ইতিহাসকে বর্তমান রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করার দায়িত্বটি বিরোধীরা পালন করতে এখনও ব্যর্থ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy