পুলিশ যদিও আক্ষরিক অর্থেই তাঁর— তিনি শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নন, পুলিশমন্ত্রীও বটে— তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন যে, পুলিশ অন্যায় করেছে। “তার জন্য সরকারের মুখ পুড়েছে।” তবে কি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মুখ্যমন্ত্রী, যেখানে তিনি তাঁর পুলিশেরও অন্যায় দেখতে পান? না কি, হরেক স্বার্থের সুতোয় পুলিশের হাত-পা-মুখ বাঁধা, ফলে তাদের প্রতিবাদের উপায় নেই— তাই তাদের দিকেই অভিযোগ-তিরের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হল? রাজ্যবাসী নিজেদের মতো করে এই জটিল ধাঁধার উত্তর সন্ধান করছেন। পুলিশ কার নির্দেশে পরিচালিত হয়, মুখ্যমন্ত্রী সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অবশ্য উত্তরটি জানেন। কেবল এই জমানায় নয়, অনেক কাল ধরেই এই প্রশ্নের উত্তর জানা। জেলা স্তরে তো বটেই, থানা অথবা পঞ্চায়েত স্তরেও পুলিশের উপর শাসক দলের কোনও না কোনও নেতার নিয়ন্ত্রণ আগের জমানাতেও ছিল, এখনও আছে। এই আমলে হয়তো উপরি যোগ হয়েছে গোষ্ঠী-আধিপত্য। থানাগুলি এখন প্রবলতর গোষ্ঠীর কথায় ওঠে এবং বসে; ক্ষীণতর গোষ্ঠীর নেতারা প্রাণপণে সেই প্রাবল্য অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু, পুলিশের এই আচরণে সরকারের মুখ পুড়লে তার দায় সরকার এবং শাসক দলের উপরই কি বর্তায় না? পুলিশের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, এবং স্থানীয় স্তরের নেতা-উপনেতাদের লাগাম দলের হাতছাড়া— এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার দায় আর কে নেবে?
রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে পুলিশ চালিত হয়, এই কথাটি আজকের ভারতে সাধারণ জ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে সেই নিয়ন্ত্রণের চরিত্র কী? পুলিশকে রাজনৈতিক রং না দেখেই আইনি পদক্ষেপ করার যে সুপরামর্শ মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, তাতে তিনি কয়েকটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন— যেমন, বালি খাদান, গাছ কাটা, অবৈধ গতিবিধি। যে ক্ষেত্রগুলির কথা তিনি বলেননি, তার মধ্যে রয়েছে পাথর খাদান, সিন্ডিকেট, গরু পাচার ইত্যাদি। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রেই জড়িয়ে রয়েছে বিপুল টাকার লেনদেন। অভিজ্ঞতা বলে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক হিংসা ঘটে চলেছে, তার মূল কারণ টাকা। স্বাভাবিক। শিল্পহীন এই রাজ্যে রাজনীতিই এখন অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্র। অভিজ্ঞ জনেরা বলবেন যে, শাসক দলের খাতায় যাঁরা নাম লেখাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য রাজ্যের হাওয়ায় উড়তে থাকা সেই টাকার নাগাল পাওয়া। সেই কাজে পুলিশের সহায়তা আবশ্যক— অবৈধ কাজগুলি চালিয়ে যাওয়ার জন্যও, বেয়াড়া বিরোধী গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করার জন্যও। তাতে যে পুলিশেরও ছিটেফোঁটা লাভ হয় না, সেই দাবি করার উপায় নেই। প্রয়োজন ছিল এই গোটা ব্যবস্থাটির চিকিৎসা করা। তা না করে শুধু পুলিশকে কাঠগড়ায় তুললে কিন্তু সত্যের অপলাপ হয়, দায়িত্বেও অবহেলা ঘটে।
অতএব, অবৈধ কাজ দেখলে রাজনৈতিক রং বিচার না করেই ব্যবস্থা করার পরামর্শটি আন্তরিক হলেও বাস্তবোচিত নয়। দু’এক জন দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু গোটা ব্যবস্থাটিই যদি দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ে, তখন গাঁ উজাড় হওয়ার উপক্রম হয়। কারণ, সমস্যার মূলে ব্যক্তিবিশেষ নয়, দলের পরিচিতি-সমন্বিত ব্যক্তিবিশেষ। পরিস্থিতিটি যদি পাল্টাতেই হয়, তবে সেই সংশোধনের সূচনা হওয়া উচিত রাজনৈতিক স্তরে— শাসক দলের পতাকা বইলেই যে দু’হাতে অর্থোপার্জনের ছাড়পত্র মেলে না, এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝিয়ে বলা জরুরি। আশঙ্কা হয়, সেই জটিলতার মধ্যে না গিয়ে পুলিশের অন্যায়ের কথা স্বীকার করে নেওয়াই সহজ। তবে কিনা, সহজ হলেও কার্যকর নয়। মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বীকৃতির ফলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুমাত্র উপকার হবে, তেমন আশা ক্ষীণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy