কার্তিক পুজো। —ফাইল চিত্র।
পরাক্রান্ত বীরকেও যে বাঙালি কী ভাবে কোঁচানো ধুতি আর লপেটা নাগরা জুতোয় শোভিত নিষ্কর্মা ফুলবাবুতে পরিণত করতে পারে, আজ, কার্তিক মাসের শেষ দিনে কার্তিক পুজোই তার সেরা প্রমাণ। দুর্গাপুজো ছাড়াও কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সকলে একাকী মর্তধামে আসেন। কারও দোষ হল না, কিন্তু বাঙালি ছেলেপুলেরা ছড়া কাটল, কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, এক বার আসে মায়ের সাথে, এক বার আসে একলা। সংস্কৃত সাহিত্য ও স্কন্দপুরাণের দেবসেনাপতিকে এ ভাবে বীরত্বহীন, মায়ের আঁচল-ধরা, লোভী বালকে পরিণত করাই বাঙালির সভ্যতা। হৃদয়ে অবশ্য বীরপ্রসবিনী হওয়ার অবদমিত কামনা আছে। ফলে, এই পুজোর দিন ‘কার্তিক ফেলা’র সংস্কৃতি। কয়েক দশক আগেও গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতির দুয়ারে কার্তিক পুজোর আগের রাতে দুষ্টু প্রতিবেশীরা এক কার্তিকমূর্তি বসিয়ে পালিয়ে যেত, সকালে উঠে সেই গৃহস্থকে পুজোর ব্যবস্থা করতেই হত। ফ্ল্যাটবাড়ির নাগরিক সংস্কৃতিতে এখন কার্তিক ফেলাও অবলুপ্ত। মহারাষ্ট্রের কল্যাণে হাল আমলের এই নকলনবিশ বঙ্গসভ্যতায় গণেশ অনেক সম্মান পেয়েছেন, অনেক জায়গাতেই তাঁর বিশাল মূর্তি তৈরি হয়। কার্তিক টিকে আছেন প্রধানত শহরের লালবাতি এলাকায়, যৌনকর্মীদের পুজোয়, এবং অন্যত্র বিক্ষিপ্ত ভাবে। কিন্তু নারীরা চান কার্তিকের মতো শোভনসুন্দর পুরুষ, চান তঁার মতো বীর পুত্র। প্রাচীন ভারতে কেউ এ ভাবে স্কন্দের আরাধনা করেননি।
স্কন্দ মানে কার্তিক। উপকথা, মহাদেবের তেজ থেকে তাঁর জন্ম। ধরিত্রী সেই তেজ সহ্য করতে না পেরে শরবনে ফেলে দেয়। অতঃপর ছয় জন কৃত্তিকা বা দেবী সেই শিশুকে স্তন্যদান ও লালনপালন করেন। তাও টেস্ট টিউব বেবি এবং দত্তক সন্তান পালনের এই যুগেও কার্তিক পাননি প্রত্যাশিত সম্মান। দিন কয়েক আগে কৃষ্ণনগর, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো হল, কিন্তু কার্তিক মাসে দুর্গাপুজো নৈব নৈব চ। বাঙালির লুপ্ত প্রবাদ, ‘পাঁজি হয়েছে উজনসুজন, কার্তিক মাসে দুর্গাপূজন।’ উজনসুজন অর্থাৎ উল্টোপাল্টা কাজ, একই মাসে কার্তিক ও দুর্গাপুজো চলবে না। আধুনিক শক্তি-আরাধনা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, রাজারাজড়ার বীরত্বের দুর্গাপুজোর উৎস। বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্যে লুক্কায়িত বৈষ্ণবী ‘নিদ্রা’ বা ‘কালরাত্রি’ দেবীতে এই মহাসেনা বা কার্তিকের বীরত্বের অবলেপ পড়ে। বীরত্বের শক্তিপুজো সংক্রান্ত আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী, স্কন্দ না থাকলে পরে দেশব্যাপী এই দুর্গাপুজো হত না। পুজোতেও এই ভাবে অভিযোজন হয়, হিন্দুত্ববাদীরা যা-ই বলুন।
কিন্তু বাংলার কার্তিক? তিনি তো ফিরে আসেন বাঙালির সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায়। দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখেছিলেন, তাঁদের গ্রামে ‘কার্তিকের লড়াই’ হত। বিসর্জনের আগে গ্রামের কার্তিক ঠাকুরগুলিকে একত্রে চৌদোলায় নিয়ে গিয়ে রে রে করে ঘোরানো হত। শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিতে ধরা থাকে, দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের গ্রামে কেমন ফি বছর উত্তেজনা, কার্তিকের চেহারা এ বার কেমন, বীর ‘সেনাপতি কার্তিক’, না কি নিরীহ, শৌখিন ‘বাবু কার্তিক’। আপাতত এই পোড়া বঙ্গদেশে বীরত্ব নেই, ‘দুপুর-কার্তিক’দেরই প্রাধান্য। প্রসঙ্গত, পঞ্চাশের দশকে কৃত্তিবাস যুগে দীপক মজুমদার মশাই ‘ম্যাটিনি আইডল’-এর অনুবাদ করেন, দুপুর-কার্তিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy