আপাতত সলতে পাকানোর সময়। লোকসভা নির্বাচনের মহোৎসব শুরু হতে পুরো দু’বছর বাকি। তার আগে প্রায় এক ডজন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই পর্বও শুরু হতে হতে ২০২২ ফুরিয়ে আসবে। আপাতত নির্বাচনী গানবাজনা ঢিমে তেতালায় চলবে, সেটা পুরোপুরি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রকৃত সমঝদার জানেন, আলাপ না জমলে সঙ্গীতের রস জমে না, সলতে পাকানোয় গোলমাল হলে প্রদীপ টিমটিম করেই, অথবা ফস করে জ্বলে উঠেই, নিবে যেতে পারে। বিশেষ করে, প্রতিপক্ষ যখন নরেন্দ্র মোদী এবং সঙ্ঘ পরিবার, তখন বিরোধী দলগুলির নির্বাচনী প্রস্তুতির পক্ষে দু’বছর কোনও সময়ই নয়। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তেলঙ্গানার কলওয়াকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাও, দিল্লি-পঞ্জাবের নবীন তারকা অরবিন্দ কেজরীওয়াল থেকে মহারাষ্ট্রের আদি ও অকৃত্রিম শরদ পওয়ার প্রমুখ নায়কনায়িকারা যদি ক্রমশই সাজো সাজো রবে মুখর এবং জোট বাঁধতে তৎপর হয়ে ওঠেন, তাঁদের কোনও ভাবেই হঠকারী বলা চলে না, বরং গণতন্ত্রের দেবী বোধ করি তাঁদের ডেকে বলবেন: একটু পা চালিয়ে।
নরেন্দ্র মোদীর ভারতে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির সংহতি বা সমন্বয় নিয়ে গণতন্ত্রের দেবীর চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি বিস্তর দেখেছেন, গণতন্ত্রের পোশাক পরে এবং তার নানা প্রকরণকে কাজে লাগিয়েই অতিনায়করা, কখনও কখনও অতিনায়িকারাও, কী ভাবে তাঁদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন। তিনি এ-কথাও জানেন যে, এমন আধিপত্যের অভিযানকে আটকাতে গেলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সমন্বয় দরকার হয়। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির বিরোধী— বা অন্তত তার নিজস্ব বলয়ের বাইরে থাকা— দলগুলি সক্রিয়, কিছু কিছু রাজ্যে সফলও বটে। কিন্তু সর্বভারতীয় পরিসরে একটা সংহত প্রতিরোধ তৈরি করার প্রয়োজন তারা এখনও মেটাতে পারেনি। এক দিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অন্য দিকে একাধিক দলনেতা বা নেত্রীর বিপুল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দুইয়ের যৌথ লীলায় বিরোধী ঐক্যের ফানুস বারংবার ভাল করে ওড়ার আগেই পপাত চ মমার চ। তৃতীয় ফ্রন্ট বা ফেডারাল ফ্রন্ট ইত্যাদি বিবিধ নামাবলিতে ভূষিত জোট-প্রচেষ্টার ইতিহাস নাগরিকরা ভুলে যাননি। সেই অতীত আগামী দু’বছরের বিরোধী রাজনীতির উপর কতটা দীর্ঘ ছায়া ফেলবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
প্রশ্নটি নানা কারণে জটিল। একটি বড় কারণের নাম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। স্বাধীন ভারতের প্রথম অর্ধ শতকের প্রায় সম্পূর্ণ সময় জুড়েই দিল্লির দরবারে যে দল ছিল ‘স্বাভাবিক শাসক’, ২০১৪ সালের বিপর্যয়ের পর ‘স্বাভাবিক বিরোধী’র আসনটি ধরে রাখতেও সে উত্তরোত্তর নাজেহাল। পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের পরে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের মেঘ আরও অনেক গুণ ঘনিয়ে উঠেছে। গান্ধী পরিবারের আঁচল ছাড়লে মুষলপর্ব আর আঁচল ধরে থাকলে পূর্ণগ্রাস— দুই আশঙ্কাই প্রবল; ইথাকার রাজা ইউলিসিসের পরে কেউ এমন উভয়সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু এই সঙ্কট কেবল কংগ্রেসের নয়। বিজেপি ছাড়া সে-ই আজও একমাত্র সর্বভারতীয় দল, এবং বিজেপির বিরোধী হিসাবে তার ভূমিকা নিয়েও কোনও প্রশ্ন নেই, তাই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট তৈরির উদ্যোগ করলে তার নীতিগত বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বাস্তব সম্ভাবনা, দুইই গোড়া থেকে দুর্বল হতে বাধ্য। গান্ধী পরিবার তথা তাঁদের পরিচালিত দলটির অহঙ্কার কমানোও অবশ্যই জরুরি, কিন্তু কংগ্রেসকে সঙ্গে রেখেই যদি বিরোধী দলগুলি সেই কাজটি করতে পারে, তাতে দু’পক্ষেরই মঙ্গলের সম্ভাবনা। তার সঙ্গে মঙ্গল ভারতীয় গণতন্ত্রেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy