E-Paper

দুস্তর পারাবার

পুরুষ-নারীর মধ্যে এই যে ব্যবধান তার প্রধান কারণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈচিত্রকে কালক্রমে ক্ষমতাতন্ত্রী পিতৃপুরুষেরা বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ার করে তুলেছিল।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪ ০৮:২৪
Share
Save

জেন্ডার গ্যাপ বা ‘লিঙ্গগত ব্যবধান’ বলতে ঠিক কী বোঝায় তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কম-বেশি সকলেরই আছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গবেষকরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাপ্তি ও অর্জন, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা এবং রাজনৈতিক সামর্থ্য এই নিক্তিগুলির সূত্রে বিশ্বের পুরুষ-নারীর অবস্থান বিচার করে ২০২৪-এ যে ফলাফল ঘোষণা করেছেন তাতে পুরুষ ও নারীর মাঝখানে দুস্তর ব্যবধান। মেয়েরা পিছিয়ে। সমাজের অধিকাংশ নাগরিকের মনে হয় এই তো বেশ চলছে, সব কিছু যথাযথ। এই ‘নারীর অধিকার’, ‘নারীর সুযোগ’, এ সবই এক উঁচু শ্রেণির শৌখিন আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মানবী বিদ্যা’ নামক বিষয়চর্চার ফল, সমাজের অবস্থার সঙ্গে এই বিদ্যাচর্চার কোনও যোগ নেই। এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। এই অস্বীকারপন্থার মধ্যে, দেখেও না দেখার কৌশলের ভিতরে বিপদের বীজ নিহিত আছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের অভিমত এই মুহূর্তে এই লিঙ্গগত অসাম্যজনিত ব্যবধান এত বেশি যে তা দূর করতে একশো চৌত্রিশ বছর লাগবে। এই অভিমতের সামনে ১৩৪ বছরের অঙ্কটি স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেয়, নারী-পুরুষের ব্যবধান কী বিপুল এবং, এমন বিপুল বলেই, কতটা অনৈতিক।

পুরুষ-নারীর মধ্যে এই যে ব্যবধান তার প্রধান কারণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈচিত্রকে কালক্রমে ক্ষমতাতন্ত্রী পিতৃপুরুষেরা বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ার করে তুলেছিল। প্রকৃতি নারীকে সন্তানবতী হওয়ার যে অধিকার প্রদান করেছে সেই ভেদকে কাজে লাগিয়ে পুরুষেরা নারীকে সাপেক্ষ পদে পরিণত করেছিল। অন্য দেশের কথা থাক, ভারতীয় সংস্কৃতিতে রয়েছে নানা ভাবে মেয়েদের পিছন দিকে এগিয়ে দেওয়ার আয়োজন। কন্যা, জায়া, জননী এই তিন রূপের সাপেক্ষেই মেয়েদের বিচার করার চল। ‘মনুসংহিতা’য় নিদান দেওয়া হয়েছিল নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রের অধীন। কেবল ‘মনুসংহিতা’ কেন, অপরাপর ধর্মের বিধিতেও মেয়েদের এই সাপেক্ষতা। বেগম রোকেয়া তাই অবরোধবাসিনী মেয়েদের মুক্তির স্বপ্ন দেখানোর জন্য সুলতানার স্বপ্ন রচনা করেছিলেন। সেই কল্পকাহিনিতে যে নারীরাজ্যের বিবরণ দেওয়া হয়েছিল তাতে মেয়েরা প্রতিটি কাজে স্বাধীন ও স্বনির্ভর। এই বোধই মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্ত্রীশিক্ষার বিরোধীরা ঘোষণা করেছিলেন উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের সন্তানধারণের ক্ষমতা লুপ্ত হয়। শিক্ষিত রমণীদের স্বামী বিয়োগ হয়। এমন ভাবনা সমাজ থেকে যে হারিয়ে যায়নি, বিদ্যালয়গুলির দিকে তাকালেই তা চোখে পড়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা বহুক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শিক্ষাকে বিবাহ-ব্যবস্থার বিরোধী হিসেবে দেখা হয়। যেমন-তেমন করে বিবাহেই মেয়েদের মুক্তি। তার পর ভবচক্রে সন্তানবতী জননীরই সন্তান পালনের একক দায়িত্ব, সন্তানকে নিয়ে কাজে যাওয়ার নানা অসুবিধের ছুতো দেখিয়ে তাদের অর্থনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয়। অথচ সন্তানবতী জননী সন্তানকে নিয়ে যাতে কাজ করতে পারে তার জন্য উপযুক্ত পারিবারিক পরিকাঠামো নির্মাণের প্রয়াস তেমন চোখেও পড়ে না। তা ছাড়া ভারতীয় মেয়েদের সামনে সহনশীল, সর্বংসহা জননীর আদর্শ তুলে ধরে তাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের অধিকার হরণ করার আধ্যাত্মিক কৌশল তো আছেই। সংসারে সবার আহারের পর যা থাকে সে টুকুই বরাদ্দ। এই বোধ যৌথ নিশ্চেতনে এতই প্রবল যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য কিছু করলে মেয়েরা অপরাধবোধে পীড়িত হয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মক্ষেত্র-জীবনযাত্রা সব দিক থেকেই এ ভাবে ভারতীয় মেয়েরা যখন পশ্চাদ্‌বর্তী তখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও যে তারা অধিকারশূন্য হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পঞ্চায়েতে বাড়ির মেয়েদের সামনে রেখে পুরুষদের কলকাঠি সঞ্চালনার গল্প তো চেনা।

তা হলে ব্যবধান মোচনের উপায় কী? উপায় সহজ নয়। তবে সবার আগে ব্যবধান যে আছে ও এই ব্যবধান যে ‘অনৈতিক’, সেটুকু স্বীকার করতে হবে। সমাজের সর্ব স্তরে সার্বিক সচেতনতা প্রয়োজন। সেই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জনপ্রিয় বিনোদন-মাধ্যমকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। মেয়েদের সরব যেমন হতে হবে তেমনই পুরুষদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। একটি আশার কথা অবশ্য থেকেই যায়। সামান্য হলেও সমমর্মী পুরুষদের সংখ্যা বাড়ছে। নারীর আপন ভাগ্য জয় করার সাহস আর জোরও ক্রমশ বাড়ছে বইকি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

gender equality Gender Discrimination

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।