সদ্য আততায়ীর গুলিতে নিহত টেক্সাসের স্কুলের উনিশটি শিশু কি একটুও ধাক্কা দিতে পারল তাদের যন্ত্রণাহত পরিবার-আত্মীয়বন্ধুদের বাইরের বিশাল ব্যাপ্ত আমেরিকান জনসমাজকে? কিংবা, মাত্র কয়েক দিন আগেই নিউ ইয়র্কের বাফেলো’য় বাজার-বিপণিতে একই রকম বন্দুক-গুলিতে যে দশ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁরা কি পারলেন? কিংবা প্রত্যহ ১১০ জন আমেরিকান মানুষ বন্দুকের গুলিতে হতাহত হন— গত কয়েক দশকের এই পরিসংখ্যান কি কোনও প্রশ্ন তুলে যেতে পেরেছে? বিবিধ সময়ে বিবিধ স্থানে এই নৃশংস কাণ্ডগুলির মধ্যে একটি সাধারণ শর্ত— বন্দুকের সহজলভ্যতা। আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহে আইনি সিলমোহর। ব্যক্তির নিজের নিরাপত্তাবিধানের অধিকার জ্ঞানে আগ্নেয়াস্ত্রের অপার ও খোলাখুলি কেনাবেচা। আমেরিকায় এই বিধিটি কম বিতর্কিত নয়, অথচ স্বঘোষিত সুপারপাওয়ার ও বহুঘোষিত সুসভ্যতা আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাতটি দশক কাটিয়ে দিল এই প্রশ্নটিকে যথাসাধ্য এড়িয়ে গিয়ে, নানা রকম ভুজুংভাজুং-এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্থিতির প্রতিপ্রশ্নটিকে ডুবিয়ে দিয়ে।
অজানা নয় যে, সে দেশের ‘গান-লবি’ যে হেতু অর্থনৈতিক ভাবে অতীব ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী, এবং/ফলত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অলঙ্ঘনীয়— কোনও ভাবেই সামাজিক নিরাপত্তার যুক্তি তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। আমেরিকার গোড়াপত্তনের ইতিহাসই বলে দেয়, কেন ‘গান-লবি’র সঙ্গে তার রক্ষণশীল সংস্কৃতি ওতপ্রোত জড়িত: ধরে নেওয়া হয় আগের মতোই আজও আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আত্মরক্ষা অসম্ভব। আবার আমেরিকা দেশটির বর্ণবিভক্ত সমাজের বৈষম্যের ইতিহাসও বলে দেয় কেন ‘গান-লবি’র সঙ্গে জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষের সম্পর্কটিও অঙ্গাঙ্গি। সম্প্রতি আমেরিকায় যে হেতু দক্ষিণপন্থার ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তিতে রক্ষণশীলতা ও জাতিবিদ্বেষ দুই-ই ঊর্ধ্বমুখী, ‘গান-লবি’ও ক্রমশই অপরাজেয় হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্টের আক্ষেপ ‘এখনও কি তা হলে কিছু ভাবব না আমরা’-র মধ্যে ক্লান্তি আর হতাশার সুরটি শুনতে ভুল হয় না। বন্দুকবিরোধী আমেরিকার এই হতাশা স্বাভাবিক, ক্লান্তি মর্মান্তিক। বহু রাজনৈতিক আন্দোলন, বহু নেতার অনুরোধ-অনুনয়, সকলই বৃথা ভেল। নাগরিকদের অর্ধাংশেরও বেশি তাঁদের অনতিক্রম্য ব্যক্তিগত অধিকারের অংশ হিসাবেই বন্দুককে দেখতে চান। উনিশটি সাত থেকে দশ বছরের শিশুর মৃত্যুও সেই অটল ব্যক্তিঅধিকার-বোধকে বিচলিত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
মুশকিল হল, এই সমস্যাকে কেবল ‘আমেরিকার সমস্যা’ বলে পাশে সরিয়ে রাখার বিলাসিতাটিও হয়তো আর নেই। আমেরিকার ক্ষেত্রে যে বাজার আইনত সিদ্ধ, সেই একই বাজার আইন-বেড়ির মধ্যে থাকলেও তার চোখ এড়িয়ে রমরম করে চলছে অন্যান্য মহাদেশে। ভারতেও অস্ত্রবিক্রয়ের উপর আইনের নিয়ন্ত্রণ ভেদ করে এক সমান্তরাল ভূমিতলবর্তী বাজার দিনে দিনে বিকশিত হয়ে উঠছে। রক্ষণশীলতা ও আক্রমণপরায়ণতার বর্ধমান আবহে সেই বেআইনি বাজারের প্রশ্রয়ে যে কোনও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি ব্যক্তিগত বিতণ্ডার মীমাংসা হতে পারে নিধন-নৃশংসতার মাধ্যমেই। ঘরের কাছেই দৃষ্টান্ত বিস্তর। এক পরিবারের আট সদস্যকে কুপিয়ে খুন থেকে শুরু করে নির্বাচন এলেই দু’-দশটি বন্দুকনিধন, আজ সব খবরই সহজ এবং সাধারণে পর্যবসিত। এই ভয়ানক হিংসাপরায়ণতার পিছনে যে মানসিক বিকার, তার কী প্রতিকার হতে পারে, ভাবতে হবে চিকিৎসকদের, সমাজবিশেষজ্ঞদের। কিন্তু মানসিক বিকৃতি কিংবা হিংসাপ্রবণতায় উৎসাহপ্রদানকারী অস্ত্রগুলি যাতে সহজলভ্য না হয়, তা নিশ্চিত করার কাজটি কিন্তু প্রশাসন সহজেই করতে পারে— অবশ্য যদি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সদিচ্ছা আদৌ তার থাকে!
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy