Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
Threat Culture

হুমকি রাজ

মর্মান্তিক আর জি কর ঘটনায় প্রকৃত শিকড়টি যে এই রাজ্যের অতি পরিব্যাপ্ত ও অতি গভীরচারী হুমকি প্রথার বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই খুঁজতে হবে, সেটা স্পষ্ট। এও স্পষ্ট, প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া এর মোকাবিলা করা অসম্ভব।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৬
Share: Save:

হুমকি প্রথা শব্দবন্ধটি ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আলোচনায় কেন্দ্রস্থল দখল করেছে, কিছু বছর আগে যেমন করেছিল সিন্ডিকেট রাজ। মর্মান্তিক আর জি কর
ঘটনায় প্রকৃত শিকড়টি যে এই রাজ্যের অতি পরিব্যাপ্ত ও অতি গভীরচারী হুমকি প্রথার বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই খুঁজতে হবে, সেটা স্পষ্ট। এও স্পষ্ট, প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া এর মোকাবিলা করা অসম্ভব। নাগরিক শুভবোধ কিংবা সক্রিয়তা দিয়ে হুমকি-মাফিয়াদের কথা জনসমক্ষে তুলে আনা যেতে পারে, কিন্তু তাদের নিরস্ত করার আশা বাতুলতা। চলমান আন্দোলনে অভয়ার নির্যাতন ও হত্যার বিচারের পাশে সেই কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দাবিটি যে প্রবল গুরুত্বে উঠে এসেছে, তাকে কোনও ভাবেই স্তিমিত হতে দেওয়া যাবে না— এটা এখন আবশ্যিক নাগরিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। প্রশ্ন হল, সে কাজ করবেন কে বা কারা? ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন, তাঁর নিজস্ব কার্যধারা দিয়ে তিনি কী অভ্রান্ত ভাবে এই প্রথাকে প্রত্যক্ষ আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেন, এবং ফলত, এই নাগরিক দাবি মেটাতে পারার ব্যাপারে তাঁর সম্পূর্ণ অসামর্থ্য প্রমাণ করেন? গত সোমবার জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবিধ আচরণ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, হুমকি প্রথা এ রাজ্যের রাজনীতির শীর্ষ স্তর থেকে সযত্নে ও সদর্পে প্রতিষ্ঠিত, অকুণ্ঠিত ভাবে প্রচারিত। এমতাবস্থায়, ফিরে যেতে হয় মূল প্রশ্নে। যে হুমকি রীতি রাজনৈতিক সমাজের আগাপাছতলা ছেয়ে ফেলেছে, তার উৎপাটন তো দূরস্থান, নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা, ক্ষমতা, ইচ্ছা— কোনওটাই বর্তমান রাজ্য প্রশাসনের কাছে আশা করা যায় কি?

সে দিনের বৈঠকের কয়েকটি মুহূর্ত এই প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে ‘স্মরণীয়’। একটি প্রকাশ্য বৈঠকে, যার ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ হচ্ছে, সেখানে ছাত্র ও সহকর্মীদের সামনে, এবং রাজ্য আধিকারিকদের উপস্থিতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের উদ্দেশ্য করে যে ভাবে ও ভঙ্গিতে কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে মনে হয় তাঁর মাথায় একটি সম্পর্কই প্রধান জায়গা নিয়েছে: প্রভু-ভৃত্য। আর জি কর কর্তৃপক্ষ কেন সাতচল্লিশ জনকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে যে প্রবল তর্জনে গর্জে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে সচেতন নাগরিক দর্শক হিসাবেই লজ্জিত বোধ করলেন সে দিন। সেখানকার অধ্যক্ষ ও কাউন্সিল ঠিক করেছেন না ভুল, তা অবশ্যই আইনত বিচার্য— বাস্তবিকই হাই কোর্ট তাঁদের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দিয়েছে গত মঙ্গলবারেই। কিন্তু আসল সমস্যা তো বিষয়ের গভীরে নয়, বিষয় আলোচনার সুরে ও স্বরে। একই রকম শাসানির সুর সজোরে সপাটে ধ্বনিত হল পরীক্ষার পুরনো নম্বর নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন জাতীয় হুমকিতে, যা যুক্তিতে ঠিক হোক বা না হোক, কথনভঙ্গিতে স্পষ্টত স্বৈরতান্ত্রিক।

বিগত তেরো বছরের শাসনকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভঙ্গিটি রাজ্যবাসী বারংবার দেখেছেন, বিবিধ ঘটনার অনুষঙ্গে। পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনি কাণ্ডের নির্যাতিতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, অনুব্রত মণ্ডল বা আরাবুল ইসলামের মতো দলীয় নেতার ন্যক্কারজনক কীর্তিকলাপকে অবারিত প্রশ্রয়দানে, ‘ছোট ছেলেরা ছোট ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে’ ধরনের একাধিক অন্যায় ও অমার্জনীয় ঔদাসীন্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মমতা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে নাগরিক সহমর্মিতার দূরত্ব অনেক যোজন। যে নেত্রী এক দিন নাগরিক বিক্ষোভের পথ ধরে উঠে এসেছিলেন ক্ষমতায়, নিজে শীর্ষ শাসক হয়ে তিনিই জানিয়ে দিয়েছেন, নাগরিক সমাজ তাঁর প্রশাসনের কাছে হুমকিবাজদের থেকে আশ্রয় চাইতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থমনোরথ হবেন। আজ আর জি কর ঘটনার অভিঘাতে যে প্রশ্নগুলি উঠে এসে বিপুল জনজাগরণ তৈরি করেছে, মুখ্যমন্ত্রী কি মনে করেন এই পথে তার দাবি ও আকাঙ্ক্ষা মেটানো সম্ভব? এই প্রবল দমনেচ্ছা এবং প্রভু-মাফিক শাসনধারা দিয়ে রাজ্যের প্রবহমান অসুখের চিকিৎসা কি আদৌ সম্ভব?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE