ভারত নামে দেশটির সামনে ছিল বহু স্বপ্ন।
আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে এই দিনটির প্রত্যূষে ভারত নামে দেশটির সামনে ছিল বহু স্বপ্ন। যে দেশ পরাধীনতার আগেও কখনও একটিমাত্র স্বশাসিত রাষ্ট্র ছিল না, ছিল ছড়ানোছিটানো নানা অঞ্চলের সমষ্টিমাত্র, তাকে একটি সংহত জাতিরাষ্ট্রের চেহারা দেওয়ার স্বপ্ন। যে দেশের সমাজ দারিদ্র, শোষণ অনধিকার আর যুগসঞ্চিত বঞ্চনায় স্মরণাতীত কাল যাবৎ নিমজ্জিত, সেই যন্ত্রণাপঙ্ক থেকে তাকে তুলে আনার স্বপ্ন। অর্থনীতিকে সুস্থ, সুষ্ঠু ও সবল করে নাগরিকদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। নবলব্ধ গণতন্ত্র হিসাবে জগৎসভায় এক মর্যাদাময় আসন লাভের স্বপ্ন। আজ পঁচাত্তর বছর পর পিছনে ঘুরে তাকালে বলতেই হয়— ইতিমধ্যে বেশ কিছু স্বপ্নপথ পরিক্রমা করতে সমর্থ হয়েছে এই দেশ, আংশিক ভাবে হলেও। যাত্রাপথে ছিল তীক্ষ্ণ কাঁটাবন, অতল চোরাখাদ। তবু এক শতকের তিন-চতুর্থাংশ পথ হেঁটে এসে গণতন্ত্র হিসাবে ভারত বিশ্বময় যে পরিচয় ও সম্মান অর্জন করেছে, তা খুব সামান্য কথা নয়। সুনীল খিলনানি প্রমুখ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ নাগরিকও স্বীকার করবেন যে ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী ভারতের ইতিহাস আসলে এক অসামান্য পরিব্রজন-কাহিনি, যার কেন্দ্রবিন্দু— গণতন্ত্র। যদি কোনও দিন গণতন্ত্রের ইতিহাস লেখা হয়, তা হলে আমেরিকার স্বাধীনতা, ফরাসি বিপ্লব ইত্যাদির পর খুব দূরে পিছিয়ে থাকবে না এই বিশালাকার জনবহুল দেশটির গণতন্ত্র-গাথা।
এই গৌরবগাথার মধ্যে কোনও মুহূর্তকে আলাদা করে মনে করতে হলে অবশ্যই দুটি সময়ের কথা বলতে হবে। এক, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, যখন স্বাধীন শিশুদেশটি নিজেকে দৃপ্ত গৌরবে প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করল, এবং একটি অসামান্য সংবিধানের কাছে বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করল। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে থাকা অগণিত দরিদ্র-দুঃখী মানুষ কি জানতেও পেরেছিলেন সে দিন যে, তাঁদের জন্য কী আশ্চর্য একটি রক্ষাকবচ আবির্ভূত হল এই ভারতভূমিতে— যার নাম নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার? দ্বিতীয় মুহূর্তটি এর সঙ্গেই সংযুক্ত: ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আসমুদ্রহিমাচল এই বিপুল দেশের পর্বতনদীঅরণ্য ভেদ করে প্রতি শহর গ্রাম জনপদে বিপুলসংখ্যক মানুষকে যে ভোট দিতে শেখানো যায়, রাষ্ট্রগঠনের কাজে তাদের পরোক্ষে হলেও যুক্ত করা যায়, দুশো বছর রাজত্বের পরও কি ব্রিটিশ কর্তারা কল্পনা করতে পেরেছিলেন? ইতিহাসবিদরা বলেন, আর একটি অত্যুজ্জ্বল কৃতিত্বের দাবিদার ভারত নামে এই স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশটি: বৃহৎ মাপের ‘আইডিয়া’ বা চেতনাধারা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সাহস ও দক্ষতা দেখানোর কৃতিত্ব। বহু অভাব ও অসম্পূর্ণতা থেকে গেলেও পৃথিবীর অন্য প্রাক্তন-উপনিবেশ দেশগুলির থেকে এখানেই ভারত অনেক এগিয়ে গিয়েছে, হয়তো এগিয়ে রয়েছেও।
‘হয়তো’ শব্দটি জুড়তে হত না যদি না গত কিছু কাল যাবৎ সেই সহস্র উজ্জ্বল সূর্য-খচিত গণতন্ত্রদিগন্তে রাহুগ্রাস নেমে আসত। রাজনৈতিক পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যেই আজ ভারতের শাসনকেন্দ্র টলতে শুরু করেছে পিছন দিকে। গণতন্ত্রের মূল দুটি স্তম্ভ, বাকস্বাধীনতা ও সহনশীলতা তলাতে শুরু করেছে নীচের দিকে। আগেও এ দেশ গণতন্ত্রের সঙ্কট দেখেছে, জরুরি অবস্থা দেখেছে। কিন্তু তার থেকে রাজনীতি ও সমাজ শিক্ষাও নিয়েছে, সঙ্কটমুক্তির অভিমুখের দিকে এগিয়েছে। এ বার কিন্তু অন্য রকম। সংখ্যাগুরু ও সুবিধাভোগীর স্পর্ধিত আস্ফালনে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষ প্রত্যহ বেশি করে অসহায় হয়ে পড়েছেন, দরিদ্র সম্বলহীন হচ্ছেন। এ যেন আত্মবিস্মরণের কাল, আত্মহননের প্রয়াস। গণতান্ত্রিক আবহকে যদি এই বেলা রক্ষা করা না যায়, ভারত কিন্তু তার পরিচয়টিই হারাবে, যে পরিচয়-পতাকা সে দুর্জয় দুঃসাহসে উড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy