ইউপিএ সরকারের আমলে গ্যাসের ‘আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি’র প্রতিবাদে সিলিন্ডার নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েছিলেন বিজেপির প্রথম সারির একাধিক নেতা-নেত্রী। সেই চড়া দামে সিলিন্ডার কিনতে গরিব মানুষের কতখানি সমস্যা হচ্ছে, তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে অগ্ন্যুৎপাত করেছিলেন আরও অনেকেই। তখন গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল চারশো টাকার কাছাকাছি। পরবর্তী আট বছরে গড়ে বছরে ছয় শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ধরলে এখন তার দাম হওয়া উচিত ছিল সাড়ে ছ’শো টাকার মতো। পশ্চিমবঙ্গে এখন গ্যাসের দাম সিলিন্ডারপ্রতি ১০২৬ টাকা। ঘটনাক্রমে, সে দিন যাঁরা প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন ক্ষমতাসীন— স্বভাবতই গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধিতে তাঁদের প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। কিন্তু, মানুষের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। প্রথমত, স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির হিসাবে গ্যাসের দাম যতখানি বাড়ার কথা ছিল, বেড়েছে তার দেড় গুণেরও বেশি। উপরন্তু, এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে এক ভয়ঙ্কর সময়ে— যখন ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সামগ্রিক হার আট শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। গত আট বছরে কখনও এত চড়া হারে মূল্যস্ফীতি ঘটেনি। অন্য দিকে, অতিমারি ও লকডাউনের ধাক্কায় বহু মানুষের আয় অনিশ্চিত হয়েছে, কমেছে। ফলে, এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০২০ সালের মে মাসের পর আর নতুন করে এলপিজি-র ভর্তুকিও ঘোষিত হয়নি।
ফল অবশ্যম্ভাবী— দরিদ্র পরিবারগুলি রান্নার গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া বিভিন্ন সমীক্ষায় বারে বারেই উঠে আসছে একটি ছবি— উজ্জ্বলা প্রকল্পে যাঁদের ঘরে এলপিজি সংযোগ পৌঁছেছে, তাঁদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ফিরে যাচ্ছেন অস্বাস্থ্যকর জ্বালানিতেই। কাঠকুটো, কয়লা-ঘুঁটের মতো জ্বালানি এলপিজির তুলনায় অনেক সস্তা হওয়ায় সেই বিকল্পই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন। প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী সরকার বিপুল ঢাকঢোল সহযোগে উজ্জ্বলা যোজনার সূচনা করে, পরবর্তী কালে তার দ্বিতীয় পর্যায়ও শুরু হয়। সেই যোজনায় দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের ঘরে সিলিন্ডার পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম বারের বিনামূল্যের সিলিন্ডারটি ফুরোলে বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই যে নতুন সিলিন্ডার নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এই কথাটি গবেষকরা প্রায় শুরু থেকেই বলে আসছেন। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি সেই সমস্যাটিকেই চরমে পৌঁছে দিল। অবশ্য, এটাই কি ভারতের তথাকথিত উন্নয়ননীতির প্রকৃত ছবি নয়— যেখানে মানুষ পরিষেবা পাচ্ছেন কি না, তার হিসাব নেওয়া হয় না, শুধু সংযোগের পরিসংখ্যানেই সাফল্য ঘোষিত হয়ে যায়?
এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি, এবং তার ফলে ক্রমাগত অধিকসংখ্যক মানুষের অস্বাস্থ্যকর বিকল্প জ্বালানিতে ফিরে যাওয়া বহুমাত্রিক অসাম্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক— ফলে, গরিব মানুষ বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি মেনে নিতে। এবং, সেই ক্ষতি বহুলাংশে বেশি মহিলাদের, গৃহস্থালিতে রান্নার কাজ যে-হেতু তাঁরাই করেন। বিকল্প জ্বালানিতে রান্না সময়সাপেক্ষ; জ্বালানি সংগ্রহের কাজটিও তাই। ফলে, মহিলারা বাধ্য হচ্ছেন অর্থকরী কাজে কম সময় দিতে। তাঁদের আয় করার ক্ষমতা কমছে, ফলে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্য দিকে, গ্রাম এবং শহরের মধ্যেও বৈষম্য বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে শহরাঞ্চলে যেখানে ৮০ শতাংশের বেশি পরিবারে মূল জ্বালানি এলপিজি, গ্রামাঞ্চলে তেমন পরিবারের অনুপাত কুড়ি শতাংশ। এই সমস্যাগুলির কথা দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছয় কি না, সাধারণ মানুষ তা টের পান না। তাঁরা শুধু জানেন, নেতাদের কাছে এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি নিতান্ত রাজনীতির প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy