সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর পূর্ণ হলেও, এই অঞ্চলে শান্তির আবহ এখনও দূর অস্ত্। গত বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-নির্বাচনী প্রচারে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা পূরণ করতে পারেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। বরং যুদ্ধাবসানের প্রচেষ্টার মাঝে, ঠান্ডা লড়াইয়ের দুই প্রাক্তন প্রতিপক্ষের সখ্য বৃদ্ধি উদ্বেগ বাড়িয়েছে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি-সহ ইউরোপের রাষ্ট্রনেতাদের। যে দ্রুততার সঙ্গে এই ক্ষেত্রে তাঁর ভূরাজনৈতিক অবস্থান বদল করেছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, তাতে ইঙ্গিত স্পষ্ট— ইউরোপ, নেটো এবং রাশিয়ার সঙ্গে গত আট দশকে যে সম্পর্ক থেকেছে ওয়াশিংটনের, তার পুনর্গঠনে বদ্ধপরিকর ট্রাম্প। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবসান নিয়ে সম্প্রতি সৌদি আরবে ওয়াশিংটন-মস্কোর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ইউক্রেন তো বটেই, ইউরোপের অনুপস্থিতি তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এক সময় যে রাষ্ট্র ইউক্রেনকে নেটো সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছিল, আজ সে-ই হাঁটছে উল্টো পথে। কিভ-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর অভিযোগ এনে ট্রাম্প শুধু জ়েলেনস্কির মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি, উপযুক্ত ‘লেনদেন’ দিয়ে আগেভাগে পুতিনের আগ্রাসন রদ করা যেত বলেও দাবি করেছেন।
যুদ্ধের জেরে বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জমি রাশিয়ার দখলে, যা রাশিয়াকেই ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিভ-এর উপরে চাপ বাড়াচ্ছে মস্কো। সম্প্রতি ব্রাসেলসে নেটো-র সদর দফতরে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিবও ইউক্রেনের প্রাক্-২০১৪ সীমানায় ফিরে যাওয়ার দাবিকে ‘অবাস্তব’ বলে দেন। এমনকি কিভ যেন তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি ইউরোপের উপরে চাপিয়ে দেয়, ট্রাম্প সরকারের মত এটাই। ট্রাম্পের দাবি, এ-যাবৎ ওয়াশিংটনের তরফে যে বিপুল অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, আমেরিকাকে কিভ তা পরিশোধ করুক দেশের ৫০ শতাংশ দুষ্প্রাপ্য খনিজ দিয়ে। সমস্যা হল, এই খনিজ অঞ্চলের ৪০ শতাংশই রয়েছে দেশের পূর্বে, যা এখন রাশিয়ার দখলে। সে ক্ষেত্রে খনিজের ‘টোপ’ দিয়ে মস্কো যে ওয়াশিংটনকে আরও কাছে টানার চেষ্টা করবে, সে আশঙ্কা থাকছেই। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব কতখানি রক্ষিত হবে, প্রশ্ন থাকছে সে ক্ষেত্রেও। অন্য দিকে, ট্রাম্পের এ-হেন অবস্থান চিন্তা বাড়িয়েছে ইউরোপের। ইউরোপীয় রাষ্ট্রের উপরে তাঁর শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আর্থিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রতি অতি-নির্ভরতার জেরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করা সম্ভব নয় ইউরোপের পক্ষে। এমতাবস্থায়, ওয়াশিংটনের নীতি পরিবর্তনের মোকাবিলা কী করে করা যায়, এখন ইউরোপের রাষ্ট্রনেতারা সেই পথই খুঁজছেন।
তবে, বর্তমানে ভূরাজনৈতিক এবং আর্থিক সঙ্কটের মাঝে যুদ্ধাবসানের পক্ষেই মুখিয়ে বাকি বিশ্ব। সম্প্রতি প্রচারিত বিবিধ নিষেধাজ্ঞা শুধু বিশ্ববাজারকেই নয়, খাদ্য সরবরাহ তথা জ্বালানি সংক্রান্ত নিরাপত্তার প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির মোকাবিলার লক্ষ্যেই যুদ্ধাবসান এখন অত্যন্ত জরুরি। তবে প্রশ্ন হল— যুদ্ধাবসানের প্রতিশ্রুতি কি কোনও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনতে পারবে, না কি ফের এক ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্ম দেবে?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)