আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, গভীর উৎকণ্ঠা— বাংলাদেশ ঘিরে এমন অনুভূতি কি তবে নিত্যসঙ্গী হতে চলল? ২০২৪-এর ৫ অগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে দেশে যা-যা ঘটে চলেছে তা দেখে এই প্রশ্নই জাগছে। মানুষের হাতে সেখানে ক্রমাগত নিপীড়িত হচ্ছেন সহ-মানুষ: সংখ্যালঘু, বিশেষ রাজনৈতিক দলমত-আশ্রয়ী, বা শুভবোধসম্পন্ন প্রতিবাদী নাগরিক। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে সম্প্রতি ধ্বংসলীলা চালাল উন্মত্ত ‘ছাত্র-জনতা’, আগুন লাগিয়ে বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল। একই গতি হল দেশের নানা প্রান্তে নানান বাড়ি, স্মারক, স্থাপনার। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের স্মৃতিসদন বলে নয়, যদি নিতান্ত একটি ‘পাবলিক প্রপার্টি’ বা সরকারি সম্পত্তি হিসেবেও দেখা হয় ধূলিসাৎ বাড়িটিকে, তা হলেও এই ধ্বংসের নিন্দার কোনও ভাষা নেই। কারা এই ‘নাগরিক’— সরকার, পুলিশ এমনকি সেনাবাহিনীর চোখের সামনেও যারা ‘নাগরিক সম্পত্তি’ই ধ্বংস করতে পারে? এমন নয় যে চোখের পলকে পরিস্থিতি হাতের বাইরে গিয়ে ধ্বংসকার্য সারা হল। দুষ্কৃতীরা এ কাজ করেছে দিনে-রাতে দীর্ঘ সময় ধরে, নির্বিঘ্নে, বিনা হস্তক্ষেপে। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থ বা চরম অনুৎসুক। সব মিলিয়ে একটি বৃহৎ উদ্বেগ জমা হচ্ছে সীমান্তের এ পারেও।
এই উৎকণ্ঠা স্রেফ ভারতের বা ভারতীয় স্বার্থের কথা ভেবে, এমন কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা সঙ্কীর্ণমনা। রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক পরিসর ছাড়িয়ে নিতান্ত মানবিক দৃষ্টিতে দেখলেও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অরাজক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জাগা একান্ত স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে, সংখ্যালঘু-পীড়ন প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশের অতিরেকের অভিযোগও উঠেছে পদ্মাপার থেকে। ভারতে যে বর্বর হিংস্রতা দেখা গিয়েছে ইতিপূর্বে, দেশের ভিতর থেকেই তার বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিবাদ উঠেছিল, সরব হয়েছিল শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার ও ধর্মীয় সংগঠনও। এই প্রতিবাদের স্বর নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়, তবু এরও বিরাট মূল্য আছে। ধানমণ্ডির ঘটনার পর বাংলাদেশেও এই প্রতিবাদী স্বর উঠেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই কণ্ঠরোধের যে উদগ্র নমুনা দেখা যাচ্ছে, তা ভয়াবহ। উন্মত্ত জনতা নির্যাতন করছে প্রতিবাদী মহিলাকে, কিংবা সমাজমাধ্যমে সরব অভিনেত্রীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করছে অন্তর্বর্তী সরকারেরই পুলিশ। পরিস্থিতি বুঝে অন্তর্বর্তী সরকারের কখনও নিষ্ক্রিয়তা, কখনও অতিসক্রিয়তার এই আচরণ সর্বার্থে অনৈতিক। নাগরিকের সুরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই তো যে কোনও সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ?
সে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিটিও কি কলঙ্কিত হচ্ছে না? হাসিনা সরকারের পতনের পিছনে নিশ্চিত ভাবেই তাঁর আমলের দুঃশাসনের দায় ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন দেশ, সময় ও স্থিতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারও ছ’মাস অতিক্রান্ত। কিন্তু এই সময়কালে আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি বা মানবাধিকার— কোনও ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের এমন কোনও পদক্ষেপ দেখা যায়নি যাতে আশা জাগতে পারে। ঘরের মধ্যে নিরন্তর ভাঙচুর চললে বাইরের কাঠামোটাও যে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, বোঝা দরকার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)