Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Calcutta High Court

বাঘের পিঠে সওয়ার

মহার্ঘভাতা দেশের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে যুক্ত। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের বেতনবৃদ্ধি তাঁদের আইনি অধিকার।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২২ ০৫:২৯
Share: Save:

কলকাতা হাই কোর্টেও বহাল থাকল রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের রায়। আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে যে, আগামী তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স বা ডিএ) দিতে শুরু করতে হবে রাজ্য সরকারকে। আদালতের যুক্তি স্পষ্ট— মহার্ঘভাতা দেশের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে যুক্ত। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের বেতনবৃদ্ধি তাঁদের আইনি অধিকার। বিশেষত, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কর্মরত কর্মীদের বেতন যদি বাড়ে, রাজ্যে কর্মরত আইএএস, আইপিএস অফিসাররাও যদি কেন্দ্রীয় হারে বেতন পান, তবে রাজ্যে কর্মরত রাজ্য সরকারি কর্মীদের সেই হারে বেতন না দেওয়ার অর্থ তাঁদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা। রাজ্য সরকার প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে গিয়েছিল। সেখানে রায়টি বহাল থাকার পরও সরকার কেন্দ্রের সমান হারে ডিএ দিতে রাজি হবে, না কি ফের আপিল করবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে সংশয় রয়েছে। কারণটি স্পষ্ট— বর্ধিত হারে ডিএ দিতে গেলে রাজ্যের টানাটানির ভাঁড়ারে আরও টান পড়বে। যে রাজ্যে শিল্প নেই, যথেষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, সেই রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী বা লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর মতো প্রকল্প চালাতে গেলে যে অন্যান্য আবশ্যিক খরচের খাতে টান পড়বে, এই আশঙ্কা প্রকল্পগুলির সূচনালগ্ন থেকেই ছিল। ফলে, মহার্ঘভাতা নিয়ে এই সঙ্কটটি অপ্রত্যাশিত নয়। সমস্যা হল, এই সঙ্কট থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও রাস্তা আপাতত রাজ্য সরকারের সামনে নেই। এক বার বাঘের পিঠে সওয়ার হলে তার পর নামা কঠিন।

তবে, আদালতের রায়ের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও কয়েকটি প্রশ্ন করা জরুরি। ডিভিশন বেঞ্চের এক বিচারপতি ডিএ পাওয়ার অধিকারকে কার্যত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মৌলিক অধিকার বস্তুটি দেশের সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য হতেই হয়। আদালত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আয়বৃদ্ধির অধিকারের যে যুক্তিটি পেশ করেছে, তা-ও সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান হওয়াই বিধেয়। ঘটনা হল, সরকারি চাকরি ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই মহার্ঘভাতার ব্যবস্থা নেই। দেশের শ্রমশক্তির মাত্র চার শতাংশ সরকারি চাকরি করে। বাকি ৯৬ শতাংশের যে অধিকার নেই, চার শতাংশের সেই অধিকারকে ‘মৌলিক’ বললে তা কি নৈতিক? বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একটি হিসাব পাওয়া যাচ্ছে— রাজ্যে মূল কল্যাণপ্রকল্পগুলিতে বছরে খরচের পরিমাণ চল্লিশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, এবং ৩১ শতাংশ হারে বকেয়া ডিএ দিতে হলে খরচ হবে ২৩,০০০ কোটি টাকার মতো। রাজ্যে বর্তমানে যে আর্থিক সঙ্কট, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তা বহুলাংশে সরকারের নিজেরই মুদ্রাদোষে— কিন্তু, সেই সঙ্কটের বাস্তবে দাঁড়িয়ে বকেয়া ডিএ দিতে হলে কল্যাণখাতে ব্যয়বরাদ্দ কাটছাঁট করতে হবেই। এখানেও আর একটি অনস্বীকার্য নৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে— কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মী, না কি বিপুলসংখ্যক (নিশ্চিত ভাবেই দরিদ্রতর) রাজ্যবাসী, কার স্বার্থরক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়?

এই প্রসঙ্গে আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, সরকারি কর্মীদের বেতন বা বেতনবৃদ্ধির সঙ্গে তাঁদের কর্মকুশলতা, দায়বদ্ধতা, কিছুরই কোনও সম্পর্ক নেই। নির্দিষ্ট সময় অনুসারে বেতন কমিশনের সুপারিশ আসে, তাঁদের বেতন বাড়ে। সময় হলেই পদোন্নতিও ঘটে। কাজের দক্ষতা বা দায়বদ্ধতার সঙ্গে বেতন বা উন্নতির কোনও যোগসূত্র না থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মসংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তার দায় বহন করতে হয় গোটা সমাজকে। সুতরাং, মহার্ঘভাতা ইত্যাদির তর্ক অতিক্রম করে সরকারি কর্মীদের বেতনকে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করার পথ খোঁজা জরুরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Calcutta High Court Dearness allowance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy