Advertisement
০৪ জুলাই ২০২৪
Financial Inequality

অসাম্য হ্রাসের উপায়

আয়বৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক অসাম্যের যে সম্পর্ক ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে, তার মূল রয়েছে কাজের বাজারে। যে কোনও দেশেই জনসংখ্যার সিংহভাগের কাছে আয়ের একমাত্র পথ শ্রমের বাজার।

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ ০৮:১৬
Share: Save:

ভারত সম্বন্ধে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দু’টি বিষয়ে মতৈক্য স্পষ্ট— এক, ভারতের দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি কম-বেশি অব্যাহত থাকবে; এবং দুই, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে আর্থিক বৈষম্য কমবে না। এক বহুজাতিক সংবাদ সংস্থা এ বছর মে-জুন মাসে ৫১ জন অর্থনীতিবিদকে ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে প্রশ্ন করে, এবং তাতেই উঠে আসে এই ছবিটি। কেন দ্রুত আয়বৃদ্ধি ঘটলেও আর্থিক অসাম্য কমবে না, অর্থনীতিবিদ রীতিকা খেরা তার উত্তর দিয়েছেন— আর্থিক অসাম্য স্বপ্রবৃত্ত হয়ে কমে না, তার জন্য সচেতন নীতিনির্ধারণ প্রয়োজন। ভারতের বর্তমান কর্ণধাররা আর্থিক অসাম্য হ্রাসে তেমন আগ্রহী, সে প্রমাণ এখনও মেলেনি। ফলে, অসাম্যও কমবে না। বরং, দ্রুত আয়বৃদ্ধি এই অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ সেই আয়বৃদ্ধিকে সুষম বণ্টনের পথে নিয়ে যাওয়ার নীতি বর্তমান সরকারের নেই। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার যে শপথ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন, স্পষ্টতই সেই ‘উন্নত দেশ’-এর সংজ্ঞায় সর্বজনীন উন্নয়নের ধারণাটি নেই।

আয়বৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক অসাম্যের যে সম্পর্ক ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে, তার মূল রয়েছে কাজের বাজারে। যে কোনও দেশেই জনসংখ্যার সিংহভাগের কাছে আয়ের একমাত্র পথ শ্রমের বাজার— কারণ, বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের জন্য যে পুঁজি প্রয়োজন, সিংহভাগ মানুষের কাছেই তা নেই। ভারতে আরও বেশি করে নেই— দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই শীর্ষতম এক শতাংশ ধনীর কুক্ষিগত। ফলে, সিংহভাগ ভারতীয়ের একমাত্র পুঁজি তাঁদের শ্রম ও মেধা। এই পরিস্থিতিতে দেশের শ্রম বাজারের দিকে তাকালে হতাশাজনক ছবি ফুটে ওঠে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মূল ঝোঁক স্বনিয়োজিত ক্ষেত্রের একটি বিশেষ উপক্ষেত্রের দিকে— বিনা বেতনে পারিবারিক শ্রম। অর্থাৎ, পরিসংখ্যান যত লোককে কর্মরত বলছে, তাঁদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ প্রকৃতপক্ষে আয়হীন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে; সংগঠিত ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি তাৎপর্যপূর্ণ নয়। দেশের মোট শ্রমশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়োজিত আছে কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় যে দু’টি ক্ষেত্রের সম্মিলিত মূল্য সংযোজনের পরিমাণ কুড়ি শতাংশের কাছাকাছি। ফলে, কাঠামোগত ভাবেই আর্থিক অসাম্যের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছে ভারত। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রয়াস প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যার কোনও লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান নয়।

যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব মানুষকে সংগঠিত ক্ষেত্রের তুলনায় নিরাপদ চাকরিতে নিয়ে আসা শ্রমের বাজারের মাধ্যমে অসাম্য হ্রাসের প্রকৃষ্টতম পথ। তার জন্য কর্মসংস্থান প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যতই ‘রোজগার মেলা’ করে সরকারি চাকরি বিলি করুন, সে পথে সাফল্যের সম্ভাবনা অতি সীমিত। সুস্থায়ী কর্মসংস্থান সম্ভব একমাত্র বাজারের পথে। তার জন্য যেমন বিনিয়োগ-অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন বাজারের চাহিদার। সাঙাততন্ত্রের ফাঁদ থেকে বেরোতে না পারলে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু, বাজারে চাকরি তৈরি হলেই যে অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থান হবে, তা-ও নয়। তার জন্য তরুণ প্রজন্মকে কর্মসংস্থান-যোগ্য করে তুলতে হবে। জোর দিতে হবে প্রাথমিক ও উচ্চতর শিক্ষায়, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষায়। কৃত্রিম মেধা অতি দ্রুত নিম্ন দক্ষতার কাজে শ্রমিকের প্রয়োজন কমিয়ে আনছে, ভবিষ্যতে তা আরও কমবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রম স্থির করতে হবে, তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করে তুলতে হবে সেই কাজের জন্য। আর্থিক অসাম্য কমাতে হলে এ পথে হাঁটা ভিন্ন উপায় নেই। তার জন্য প্রয়োজন স্পষ্ট নীতি, এবং সেই নীতি অনুসরণের সদিচ্ছা। ভারতের বর্তমান শাসকদের সেই সদিচ্ছা আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economic Growth India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE