শতাব্দীপ্রাচীন প্রিজ়নার্স অ্যাক্ট (১৯২০)-কে অপসারিত করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি সংসদে ক্রিমিনাল প্রসিডিয়র (আইডেন্টিফিকেশন) বিল পেশ করা হল। বর্তমান শাসকদের মানসিকতার সঙ্গে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা নাগরিক এ কথা জেনে আর বিস্মিত হবেন না যে, এই নতুন বিল বিপুল তথ্য সংগ্রহের পথ খুলছে। কোনও মামলায় গ্রেফতার হলে তো বটেই, প্রতিরোধমূলক গ্রেফতার আইনেও কাউকে আটকানো হলে পুলিশ তাঁর বিবিধ জৈবিক তথ্য আহরণ করতে পারবে। পুরনো আইনে আঙুল এবং পায়ের ছাপ নেওয়ার সংস্থান ছিল। নতুন আইনে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে হাতের পাতা, চোখের মণি ও রেটিনার স্ক্যান; রক্ত, বীর্য, চুল ইত্যাদির বিশ্লেষণ। তার সঙ্গে হাতের লেখা, স্বাক্ষর ইত্যাদিও সংগ্রহ করা হবে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোকে অধিকার দেওয়া হয়েছে যে, তথ্য সংগ্রহের পর পঁচাত্তর বছর তারা সেই তথ্য মজুত রাখতে পারবে। প্রস্তাবিত আইনের এই পরিধিটি যে ভয়ঙ্কর, তাতে সন্দেহ নেই। তার দু’টি দিক— এক, বিপুল পরিমাণ অতি ব্যক্তিগত তথ্য হস্তগত করা; দুই, ঠিক কারা এই আইনের আওতায় আসবেন, সে বিষয়ে বিলের ভাষা অতি ধোঁয়াটে হওয়ায় তৈরি হওয়া আশঙ্কা যে, বিপুল সংখ্যক মানুষ এই আইনের দ্বারা প্রভাবিত হতে চলেছেন। এমন আইন আদৌ সাংবিধানিক কি না, সেই প্রশ্নটি করা প্রয়োজন।
জাস্টিস পুট্টাস্বামী মামলায় ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে জানায় যে, ভারতীয় সংবিধান দেশের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে মৌলিক বলে বিবেচনা করে। এই অধিকার জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারতীয় সংবিধানে কোনও মৌলিক অধিকারই চূড়ান্ত নয়— ক্ষেত্রবিশেষে সেই অধিকার লঙ্ঘন করার এক্তিয়ার রাষ্ট্রের আছে। কিন্তু, রাষ্ট্র চাইলেই তা করতে পারে না— কোনও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। জাস্টিস পুট্টাস্বামী মামলার রায়েই তথ্যের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দু’টি শর্ত স্থির করে দিয়েছিল আদালত। এক, কেন এই উল্লঙ্ঘন জরুরি তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; দুই, যে উদ্দেশ্যে নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তা যে লঙ্ঘনের মাত্রার সঙ্গে সমানুপাতিক, সে কথা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদে সরকার যে বিলটি পেশ করেছে, তা সম্ভবত এই দু’টি মাপকাঠির একটিতেও উতরোবে না। কেন এমন দানবীয় আইন জরুরি, তার ব্যাখ্যা অতি অস্পষ্ট। উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ব্যবস্থা হলে অপরাধ প্রমাণের এবং শাস্তিবিধানের হার বাড়বে। কিন্তু, এত দিন কেবলমাত্র এই তথ্য থাকার কারণেই সেই হার কম ছিল কি না, তার সপক্ষে কোনও অকাট্য সমীক্ষা বা তথ্য নেই। এবং, উদ্দেশ্যই যেখানে অস্পষ্ট সেখানে তার সমানুপাতিকতা বিচার অসম্ভব। উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, জোর করে অভিযুক্তের নার্কো অ্যানালিসিস, ব্রেন পলিগ্রাফ ইত্যাদি করা সংবিধানবিরোধী। এই বিলের ক্ষেত্রেও রায়টি স্মরণে রাখা ভাল।
বিলটির আসল উদ্দেশ্য কী, সেই প্রশ্নটিও করা প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে ভারতে জৈবতথ্য-নির্ভরতার মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বেড়েছে— প্রায় সব কাজেই এখন আধার ব্যবহৃত হয়। কেউ বলতেই পারেন যে, এই প্রস্তাবিত আইনটি আসলে সরকারপক্ষের রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘প্রোফাইলিং’ করার উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে— এক বার কেউ সরকার-বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হলে তাঁকে আজীবন বিবিধ বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এবং, সেই সম্ভাবনা নাগরিকের মধ্যে প্রবল ভীতির সঞ্চার করবে যে, সরকার আক্ষরিক অর্থেই তার বিরোধীদের ভুলবে না। গণতন্ত্রের পক্ষে এই পরিস্থিতি অতি মারাত্মক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy