Advertisement
E-Paper

হাসতে তাদের মানা

রূঢ় গাম্ভীর্যের আড়ালে স্বৈরশাসকের অন্তঃসারশূন্যতা মুহূর্তে উন্মোচিত হয় হাসির তরবারি চালনায়। এই কারণেই, স্বৈরশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু হাসি।

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫ ০৬:০৮
Share
Save

হাসির চেয়ে বড় অন্তর্ঘাত আর হয় না, এ কথাটি সর্বাধিপত্যকামী শাসন সর্বদা জানে। সে শাসন দাঁড়িয়ে থাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যের ভিত্তির উপরে, কঠোর অনুশাসনের মন্ত্রে। সর্বাধিপত্যকামী শাসনে প্রশ্ন করা নিষেধ— সেখানে ‘সর্বশক্তিমান নেতা’ যা বলেন, তাকেই ধ্রুব সত্য জ্ঞান করা বিধেয়। হাসি আবার প্রশ্নেরও এক কাঠি বাড়া— প্রশ্ন শুধু স্বৈরশাসকের অন্যায়গুলির দিকে নির্দেশ করতে চায়; হাসি নস্যাৎ করে দেয় তাঁর ফোলানো-ফাঁপানো অস্তিত্বের সর্বস্বকে। রূঢ় গাম্ভীর্যের আড়ালে স্বৈরশাসকের অন্তঃসারশূন্যতা মুহূর্তে উন্মোচিত হয় হাসির তরবারি চালনায়। এই কারণেই, স্বৈরশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু হাসি। আরও স্পষ্ট করে বললে, শাসনক্ষমতার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও নাগরিকের হাসি। তাঁর হাসি বিপজ্জনকতর, কারণ সেই নাগরিকের রাজক্ষমতা অর্জনের প্রত্যক্ষ লালসা নেই; শাসককে তুষ্ট করে তাঁর ছুড়ে দেওয়া হাড়েও আসক্তি নেই। অন্য দিকে, সেই নাগরিকের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতার তিলমাত্র নেই, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রতিরোধের সামান্যতম উপায় নেই তাঁর। সর্বাধিপত্যকামী শাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র হাসি— প্রকাশ্য, তীব্র, চাবুকসম হাসি— তাঁর অহিংস অসহযোগ। ইতিহাস সাক্ষী, এমন প্রতিরোধকে সর্বাধিপত্যকামী শাসন ভয়ানক ভয় পায়। এবং, ভয় পায় বলেই সর্বশক্তিতে তাকে দমন করতে থাকে। বিশ্বের সর্বত্র, ইতিহাসের যে কোনও পর্যায়ে, রাজনৈতিক বিশ্বাসের যে মেরুতে অবস্থিত স্বৈরশাসনই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, তার মধ্যে একটি মিল অনস্বীকার্য— স্বৈর শাসনের ‘সেন্স অব হিউমার’ নেই। রসিকতা তার প্রবলতম শত্রু। এবং, স্বৈরশাসনের দুর্গের প্রাচীর যতই অভেদ্য হোক, তার আনাচেকানাচে ফাটল খুঁজে উঁকি দেবেই হাসির অদম্য চারাগাছ।

গত এক দশকে ভারতে গৈরিক জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির প্রবল থেকে প্রবলতর আক্রোশকে দেখতে হবে এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতেই। কুণাল কামরা সেই রাজরোষের বৃহত্তম শিকার, কিন্তু একমাত্র নন। বীর দাস, মুনাব্বর ফারুকি, অগ্রিমা জোশুয়া বা তন্ময় ভাটও সেই একই প্রতিহিংসার সাক্ষ্য দেবেন। বিজেপির মুষ্টি যত কঠোর হয়েছে, হাসির দমকও ততই বেড়েছে। এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা মঞ্চে উঠে আক্ষরিক অর্থেই হাসতে হাসতে বেআব্রু করেছেন শাসকের বিবিধ দ্বিচারিতাকে, গণতন্ত্রহীনতাকে। দেখিয়েছেন, কী ভাবে একশৈলিক গৈরিক শাসন এ দেশের সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করছে; কী ভাবে মহিলা, দলিত, যৌন সংখ্যালঘুরা কোণঠাসা হয়েছেন ক্রমাগত। সবচেয়ে বিপদের কথা, তাঁরা যখন রসিকতার মোড়কে এই কথাগুলি বলেছেন, প্রেক্ষাগৃহ-ভরা দর্শক তাতে হেসে উঠেছেন; ইউটিউব-ওটিটি বাহিত হয়ে সে হাসির রেশ পৌঁছেছে বৃহত্তর জনসমাজে। বিজেপি এতে অবাধ্যতার সিঁদুরে মেঘ দেখবেই। হাসির মতো অবাধ্যতাও বড় ছোঁয়াচে— সেই অস্ত্র কালক্রমে স্বৈরশাসনের ‘বৈধতা’ কেড়ে নিতে পারে।

কিন্তু, শুধু নেতারাই তো নন, সাধারণ মানুষও তো খড়্গহস্ত হন এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের বিরুদ্ধে। যাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা ঠোকেনি এখনও, তাঁরা প্রতিনিয়ত হুমকি পান, কুকথায় ভরে ওঠে তাঁদের ইনবক্স, মঞ্চে হেনস্থা হন। স্বৈরশাসনের সাফল্যের প্রথম শর্ত, সর্বাধিপত্যকামী নেতাকে জনমানসে যাবতীয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা— তিনি যা করছেন, সেটাই ঠিক, তাঁর আচরণেই নির্ধারিত হয় ঠিক-ভুলের সীমারেখা; এবং, তাঁকে প্রশ্ন করার, তাঁর আচরণকে অবৈধ বলার ধৃষ্টতা যে দেখায়, সে শত্রু। দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র স্বৈরশাসককে কেন্দ্র করে এই সম্মতি নির্মাণ করে, দুনিয়া জুড়েই। ভারতেও তা হয়েছে। কুণাল কামরার মতো কমেডিয়ানরা জানেন যে, তাঁরা যখন হাসির অস্ত্রে শাসককে বেঁধেন, তখন এই গোটা বাস্তুতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তবুও তাঁরা হাসতে ছাড়েন না। এই হাসিকে ভয় না পেয়ে শাসকের উপায় কী?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian comedians Ruler Stand up comedian

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}