রোগী ও তাঁর পরিজনের উদ্বেগ নিরসন করার জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বিমা প্রকল্প চালু করেছিল রাজ্য, কিন্তু প্রকল্পটিই ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রাপ্য টাকা বকেয়া থেকে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলির সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত অব্যাহত। এ বার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা-সঙ্কট ঘনিয়ে আসছে ‘প্রতিশ্রুতি বিমা’-র টাকা না পাওয়ায়। এই বিমার অধীনে কার্ডধারীর চিকিৎসার খরচ সরাসরি মেটায় রাজ্য সরকার, বিমা কোম্পানির ভূমিকা সেখানে থাকে না। সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ বা পরীক্ষা না পাওয়া গেলে সেগুলি বাইরে থেকে কেনার খরচ মেটাবে হাসপাতাল, পরে সে টাকা মেটাবে সরকার— এই হল পরিকল্পনা। সংবাদে প্রকাশ, সেই প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটেছে সরকার। জেলা হাসপাতালগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিশ্রুতি বিমার টাকা সরকার দেবে না। অন্য প্রকল্প থেকে টাকা জোগাবে হাসপাতালগুলিতে, বকেয়া মেটাতে মাঝেমাঝে কিছু অর্থ সহায়তা করা হবে। এর ফলে স্বভাবতই বেসরকারি পরীক্ষাগার এবং ওষুধ সংস্থাগুলির কাছে সরকারি হাসপাতালগুলির কোটি কোটি টাকা বকেয়া জমে যাচ্ছে। টান পড়ছে চিকিৎসার উপকরণে। রাজ্য সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে নিশ্চুপ হাসপাতাল কর্তারা। হয় চিকিৎসকরা গোপনে বাইরের ওষুধ, পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন, না হলে হাসপাতালে মজুত ওষুধ ও সরঞ্জাম দিয়েই যথাসম্ভব চিকিৎসা করছেন। রোগীর প্রয়োজনের কতটুকু সত্যিই মেটাতে পারছে হাসপাতাল, রাজ্যবাসীর কাছে তা অস্বচ্ছ।
এই অস্বচ্ছতা রাজ্য সরকারের সব প্রকল্পেরই সঙ্গী, কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীর ক্ষেত্রে তা যেন রোগীর কল্যাণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলি দাবি করেছে যে, সরকার চিকিৎসার খরচের যে হার বেঁধে দিচ্ছে, সেই হার কী করে কার্যকর হতে পারে, তার বিশ্লেষণ হোক। সরকার তা করেনি। গত মার্চ মাসে কুড়িটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য দফতরকে চিঠি দিয়ে চিকিৎসার ‘প্যাকেজ’-এর অঙ্ক বাড়াতে, এবং দু’শো কোটি টাকা বকেয়া মেটাতে অনুরোধ করেছিলেন। তার পরেও স্বচ্ছতা, তৎপরতা দেখা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে রোগী ভর্তি না করলে নানা আইনি ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছেন, কিন্তু বিধি অনুসারে রোগী ছাড়া পাওয়ার কুড়ি দিনের মাথায় হাসপাতালকে চিকিৎসার টাকা মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি। স্বাস্থ্য আন্দোলনে যুক্ত মানুষরা দাবি করেছেন, স্বাস্থ্যবিমার টাকা দিতে যদি সরকার এই বিপুল টাকা খরচ করে, তা হলে চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি হবে কী করে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
চিকিৎসার এই সঙ্কটের উৎপত্তি রাজনৈতিক সংঘাতে। এক দিকে ২০১৯ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা’ প্রত্যাখ্যান করেছে রাজ্য। ফলে চিকিৎসা খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা হারাচ্ছে রাজ্যবাসী। অন্য দিকে, রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যবিমার বিস্তার দ্রুত বাড়িয়েছে। বর্তমানে দু’কোটিরও অধিক পরিবার, অর্থাৎ কার্যত দশ কোটি মানুষ এসেছেন প্রকল্পের অধীনে। ফলে টাকার বরাদ্দ বাড়িয়েও খরচ কুলোচ্ছে না। চলতি অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যসাথীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা, যা মোট স্বাস্থ্য বাজেটের (১৭,৫৭৭ কোটি টাকা) চোদ্দো শতাংশ। কিন্তু গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ায় মাথাপিছু বরাদ্দ একই রয়ে যাচ্ছে। বিমা করেও যদি সুচিকিৎসার আশ্বাস না মেলে, যদি হাসপাতাল রোগীকে প্রত্যাখ্যান করে, অচিকিৎসায়, অসম্পূর্ণ চিকিৎসায় দীর্ঘ দিন ভুগতে হয় রোগযন্ত্রণায়, তার দায় রাজ্য সরকারের উপরেই বর্তায়। প্রয়োজন সরকারের স্বচ্ছতা, আত্মবিশ্লেষণ।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy