—প্রতীকী চিত্র।
বহু ক্ষেত্রেই খেয়াল থাকে না যে, ছাত্র শব্দের সাপেক্ষে যদি আচার্য, গুরু বা শিক্ষক শব্দের বিচার করা হয়, তা হলে তা কর্তৃত্বব্যঞ্জক। ছত্র ধারণ করে যে, সে-ই ছাত্র— নিহিতার্থ, গুরুর মাথায় ছত্র ধারণ করে যে সেই ছাত্র। এই অর্থ খুব নির্দোষ নয়। এই রীতি গুরুকে ক্ষমতাধর করে তুলছে, পরশ্রমজীবীও। ছাত্র যতই সম্মান প্রদর্শনের জন্য গুরুর মাথায় ছত্র ধারণ করুন না কেন, এই সম্মান প্রদর্শনের প্রক্রিয়া গুরুকে ক্ষমতালোভী করে তুলতে পারে, এবং করেও। তিনি ছাত্র দেখলেই ভাবতে পারেন যে, সে আমার জন্য পরম বিনয়ে শ্রমদান করছে না কেন। কালের নিয়মে বিদ্যায় পুরুষদের প্রশ্নাতীত সংখ্যাধিক্য হ্রাস পেয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়নি। গুরুমূর্তিটি আনুগত্য ও তাঁর জন্য নিঃশর্ত শ্রম দাবি করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা আচার্যের পদ গ্রহণ করলেও এই সাবেক ক্ষমতাতন্ত্রী পিতৃতন্ত্রের রীতি অনেক সময় শিক্ষকের আদর্শ হিসাবে মেনে চলেছেন। পড়ুয়ার সঙ্গে পাঠদান করেন যিনি, তাঁর সম্পর্কটি ক্ষমতার হয়ে উঠেছে।
এই ক্ষমতার চরিত্র যে কেবল ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার স্তরেই সীমিত থাকে, তা নয়— অনেক সময় রাষ্ট্র তা ব্যবহার করতে চায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুক্তধারা নাটকে এমনই এক বিদ্যালয়ব্যবস্থার ছবি এঁকেছিলেন। সেখানে গুরুমশাই তাঁর ছাত্রদের অন্য অঞ্চলের মানুষদের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তোলেন। তারই ফল হিংস্রতা। গুরুমশাইটি মহারাজকে জানাতে ভোলেন না যে, “উত্তরকূটের বাইরে যে হতভাগারা মাতৃগর্ভে জন্মায়, একদিন এইসব ছেলেরাই তাদের বিভীষিকা হয়ে উঠবে। এ যদি না হয় তবে আমি মিথ্যে গুরু। কতবড়ো দায়িত্ব যে আমাদের সে আমি একদণ্ডও ভুলি নে। আমরাই তো মানুষ তৈরি করে দিই, আপনার অমাত্যরা তাঁদের নিয়ে ব্যবহার করেন।” রবীন্দ্রনাথ এখানে ক্ষমতার একটি স্তরীভূত রূপ প্রকাশ করেছেন। গুরু তাঁর ক্ষমতাতান্ত্রিক মনোভঙ্গিতে যে সঙ্কীর্ণ লড়াইমুখী হিংস্র শিক্ষা দিচ্ছেন, সেই হিংস্র শিক্ষার সুফল রাষ্ট্র ভোগ করছে— অমাত্যরা এই ছাত্রদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হিংস্র পুতুল হিসাবে ব্যবহার করছে। তাদের ভূখণ্ডের বাইরে যারা আছে, তাদের পক্ষে এই পড়ুয়ারা বিভীষিকা হয়ে উঠবে। শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীকে এমন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটেছে, অথবা সমাজ সে পথে হাঁটতে মনস্থ করেছে, এ সময়ে দাঁড়িয়ে তেমন দাবি অবাস্তব।
এই যে ক্ষমতাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, এর থেকে পড়ুয়া ও পাঠদাতার সম্পর্ককে কী ভাবে মুক্ত করা যায়? ভারতীয় চিন্তনেই এর প্রতিষেধক ছিল। উপনিষদে আচার্য ও ছাত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের আদর্শ রূপ কী হবে, তা বোঝাতে গিয়ে প্রার্থনা করা হয়েছিল যে, তাঁরা যেন পরস্পর পরস্পরকে বিদ্বেষ না করেন। তখনই বিদ্বেষ তৈরি হয় যখন আচার্য পড়ুয়াকে পুতুলের মতো ব্যবহার করবেন, অশ্রদ্ধা করবেন, দাসানুদাস বলে মনে করবেন। বিদ্বেষ না-করার অর্থ পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধা করা। অর্থাৎ কেবল পড়ুয়াই আচার্যকে মর্যাদা দেবেন না, আচার্যও পড়ুয়াকে মর্যাদা দেবেন। আচার্য পড়ুয়াকে কোনও অর্থেই ব্যবহার করবেন না। ভারতীয় ভাবনায় আর একটি শব্দও শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পরিপ্রশ্নের অধিকার পড়ুয়ার থাকবে। তিনি আচার্যের বাক্য ও ভাবনাকে যাচাই করতে পারবেন। তার জন্য অবশ্য পড়ুয়ার প্রস্তুতি প্রয়োজন— কী ভাবে বিচার করতে হয়, এই অনুশীলনের মাধ্যমেই পড়ুয়া পরিপ্রশ্নশীল হয়ে উঠতে পারেন। শীল শব্দটি লক্ষণীয়। পড়ুয়ারও প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে— ধ্বংসাত্মক বিদ্বেষ নিয়ে প্রশ্ন করতে চাইলে বিদ্যাসাগর মূর্তির মুণ্ড ভূলুণ্ঠিত করতেই ইচ্ছে করবে। বিদ্যাসাগর কী করেছিলেন, তা বিচার করতে ইচ্ছে করবে না। পরিপ্রশ্নের অধিকার ধ্বংসাত্মক নৈরাজ্যের অধিকার নয়। রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষীয় শিক্ষার ইতিবাচক আদর্শগুলি তাঁর শিক্ষালয়ে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এক জন শিক্ষকের মধ্যে দু’টি গুণের সমাহার চেয়েছিলেন— শিক্ষক যেন তাঁর শিশুসুলভ প্রাণময়তা ও ক্ষমাধর্ম এই দুই ত্যাগ না করেন। পড়ুয়ারা এমন অনেক কিছু ভাবে ও করে, যা বৃদ্ধদের কাছে বাতুলতা বলে পরিগণিত হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক তা প্রাণধর্ম বলে মেনে নেবেন। দ্বিতীয়ত, পড়ুয়ারা যদি এমন কিছু করে যা অনুচিত কিন্তু পরিশোধনযোগ্য, সে ক্ষেত্রে শিক্ষক পরিশোধনপন্থী হবেন। এই প্রাণধর্মকে স্বীকার করে, পরিশোধনের নীতি মেনে, পরিপ্রশ্নকে স্বীকৃতি দিয়ে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার ভিত্তিতে যদি পড়ুয়া ও শিক্ষাদাতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তা হলেই ক্ষমতার শিকল ছিন্ন হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy