ভয়ঙ্কর জঙ্গিহানার স্মৃতি সম্ভবত জনমানস থেকে কখনও মোছে না। আমেরিকা ৯/১১-কে ভুলতে পারেনি; ভারত ভোলেনি ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরের কথা। ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখটিও সেই মর্মান্তিক তালিকায় স্থান পাবে। কোনও ঘটনার স্মৃতি কী ভাবে নির্মিত হয়, সে প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারও পক্ষেই কোনও ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ স্মরণে রাখা সম্ভব নয়— তা মনুষ্য মস্তিষ্কের সাধ্যাতীত। কোনও ঘটনার স্মৃতি হিসাবে কোনও মানুষের মন— এমনকি, সামগ্রিক ভাবে একটি জনগোষ্ঠীর, একটি জাতির, একটি দেশের বা সমগ্র বিশ্বের মন— যা স্মরণে রাখে, তা হল কয়েকটি মুহূর্ত, ঘটনা, কথা অথবা ধারণা। এমন কিছু, মন যাকে সেই ঘটনার ‘এসেন্স’ অথবা সারাৎসার বলে চিহ্নিত করে। যেমন ব্যক্তি-মানুষ, তেমনই সমষ্টিও পরিপার্শ্ব থেকে সূত্র নিয়ে বুঝতে চায় যে, কোন মুহূর্তগুলি এই ঘটনার স্মৃতি নির্মাণে ‘স্মরণীয়’। সেই ‘স্মৃতি’ অতঃপর ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করতে থাকে— ব্যক্তিরও, সমষ্টিরও। স্মৃতি যদি ঘৃণার হয়, তবে ভবিষ্যতের পথ হয়ে উঠতে থাকে বিদ্বিষ্টতর। এই কারণেই, জঙ্গিহানার মতো নিছক ঘৃণা-অপরাধের পর-মুহূর্তগুলির গুরুত্ব বাড়িয়ে বলা অসম্ভব।
জঙ্গিরা যে ঘৃণার দ্বারা চালিত হয়ে অপরাধটি ঘটায়, জনমানস যদি শুধু সেই ঘৃণাটুকুই স্মরণে রাখে, এবং ভবিষ্যতে তার ভিত্তিতেই চালিত হয়, তবে তা সেই জঙ্গিদেরই জয়। তবে, শুধু জঙ্গিদেরই নয়, তাদের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদও ঠিক এই ঘৃণাকেই চায়। পহেলগামের মর্মান্তিক ঘটনাকেও সেই ঘৃণা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা তো বটেই, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা। এই ঘৃণা উগ্র হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রধান মূলধন, ফলে পহেলগামকে কেন্দ্র করে যত দূর পুঁজি বাড়িয়ে নেওয়া যায়, সে চেষ্টা চলছে। আইটি সেলের মিথ্যা প্রচার তীব্রতর হয়েছে; বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই একে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে দেগে দিয়ে তার বদলা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। বহু সংবাদমাধ্যমও ন্যক্কারজনক ভাবে এই ভয়ঙ্কর খেলার দোসর— টেলিভিশনের জনপ্রিয় অ্যাঙ্কর ‘সেকুলার’-দের দেশত্যাগ করতে বলছেন। সংবাদমাধ্যম-সমাজমাধ্যমে তারস্বরে অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে যে, ধর্মে মুসলমান বলেই ভারতের প্রতিটি মুসলমান এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী। জম্মু-কাশ্মীরের এক সাংবাদিক স্থানীয় বিজেপি নেতাদের কিছু অপ্রিয় সত্য প্রশ্ন করায় তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে দেগে দিয়ে প্রহার করা হয়েছে। দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র জানে, ঘটনার অভিঘাত ফুরানোর আগেই যদি ঘৃণাকে সর্বাত্মক করে তোলা যায়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্মৃতিতে শুধু ঘৃণাই থাকবে।
আপাত-ধর্মনিরপেক্ষ বহু মানুষের ভিতর থেকেও বেরিয়ে আসছে বিদ্বিষ্ট সত্তা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র অবিশ্বাস্য ঘৃণাকে পোস্টারে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। এক চিকিৎসক শুধু মুসলমান বলে এক রোগিণীকে দেখতে অস্বীকার করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ কাশ্মীরিরা। মুসলমানরা সম্মুখীন হচ্ছেন সুতীব্র ঘৃণার। স্বাভাবিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের দিকে আঙুল তুলে বলা হচ্ছে, তাঁরা যেহেতু মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের বিরোধিতা করেন, অতএব এই সন্ত্রাসবাদের দায় তাঁদের! এমনকি রব উঠেছে, ইজ়রায়েল যেমন গাজ়ায় আক্রমণ করে, ভারতকেও তা করতে হবে— পাকিস্তানের উপরে, না কি ‘দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু’দের বিরুদ্ধে, সে কথা বিদ্বেষীরা স্পষ্ট করে বলেননি। গাজ়ার অকল্পনীয় হত্যালীলার রাষ্ট্রীয় পুনরাবৃত্তি যাঁরা দাবি করতে পারেন, তাঁদের মনুষ্যত্ব নিয়ে সংশয় হওয়াই স্বাভাবিক। ঘৃণা ঠিক এই বিকৃতিই ঘটায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই ঘৃণাই চায়, ঠিক যেমন চায় সন্ত্রাসবাদীরা। দুইয়ের মধ্যে ফারাক খুব উল্লেখযোগ্য নয়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)