জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনে এরই মধ্যে নানা সঙ্কট চিহ্নিত। তাদের মোকাবিলায় চলছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা— অনেকগুলিই এখনও পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরে। এরই মধ্যে জানা গেল, বিপদের আশঙ্কা ভাতের পাতেও। দ্য লান্সেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা: দেখা যাচ্ছে, দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে বদলে যেতেই পারে ভূমি-রসায়ন, যার জেরে ধান বা চালের দানায় বাড়তে পারে আর্সেনিকের মাত্রা। অর্থাৎ জলবায়ু সঙ্কটের দুই পান্ডা, তাপমাত্রা ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বর্ধিত মাত্রায় ‘দূষিত’ হতে পারে মাটি ও সেচের জল, তা দিয়ে ধানচাষ হলে ক্রমে ফসল তথা চালে অজৈব আর্সেনিকের মাত্রাটিও হতে পারে মাত্রাছাড়া।
এই গবেষণা এশিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলির জন্য বিপদঘণ্টা, যেখানে মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ভারত, বাংলাদেশ, চিন, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপিনস ও ভিয়েতনাম, সাতটি দেশের ২৮ ধরনের ধান/চালের উপর তাপমাত্রা ও কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধির জের গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন দশ বছর ধরে, হিসাব কষেছেন আর্সেনিকের মাত্রাবৃদ্ধি ও তার ফলে হতে পারে এমন রোগ-অসুখেরও। হিসাবটি মোটেই সুখকর নয়: বেশি মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত চাল/ভাত খাওয়ার অভ্যাসে ক্যানসারের আশঙ্কা বেড়ে যাবে বহু গুণ। গবেষকদের হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে চিনে ১.৩৪ কোটি মানুষের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, সমীক্ষাভুক্ত সাতটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ক্যানসার বাদে অন্য ঝুঁকিও মারাত্মক, আর্সেনিক-দুষ্ট ভাত খেয়ে হতে পারে কার্ডিয়োভাসকুলার রোগ, বাড়তে পারে ডায়াবিটিস, গর্ভাবস্থা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় থাবা বসাতে পারে তা।
চিনের উদাহরণেই বলা যায়, ভারতের মতো জনবহুল ও অন্নপ্রিয় দেশে এই বিপদের মাত্রা কোন জায়গায় পৌঁছতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পঁচিশ বছর খুব দূরে নয়, বিজ্ঞান-গবেষণা ভবিষ্যতের যে চেতাবনি দিচ্ছে তা নিয়ে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় স্তরে সচেতন হওয়া দরকার। গবেষকরা সম্ভাব্য প্রতিকারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন— এক দিকে আর্সেনিকের মাত্রাবৃদ্ধি মোকাবিলায় ধানচাষের ক্ষেত্রে ভূমি ও জলের ব্যবহার তথা নিয়ন্ত্রণকে বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপে পোক্ত করা, অন্য দিকে জনস্বাস্থ্যক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি। এ কথা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, এ কাজটি রাষ্ট্র তথা সরকারের, কেন্দ্র-রাজ্য মিলেমিশে এ কাজ করতে হবে এবং অবিলম্বে তা শুরু হওয়া দরকার। ‘বিদেশের বিজ্ঞান-গবেষণা, অতএব কানে না তোলাই ভাল’, ‘ভারতের কৃষিবিজ্ঞান আদর্শ’, কিংবা ‘সব ঠিক আছে’— সাম্প্রতিক কালের এই পরমতধ্বংসী ও আত্মপ্রিয় বয়ান এ ক্ষেত্রেও চালিয়ে দিলে সমূহ বিপদ হতে পারে অচিরেই। জলবায়ু বিপর্যয় এই সময়ের সবচেয়ে বড় সঙ্কট, আর্সেনিকের রূপে তা একেবারে ভাতের পাতে দেখা দিলে এত বড় দেশে তা মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। ভারতে বিজ্ঞান বিজ্ঞানের মতো থাকে আর রাষ্ট্র বরাবর রাষ্ট্রের মতো, এই দূরত্ব মোছার সময় এসেছে। জলবায়ু সঙ্কটের জের এসে পড়েছে নাগরিকের বাড়া ভাতে, বিজ্ঞান তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিচ্ছে, এ বার বাকি ও আসল কাজ রাষ্ট্রের।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)