Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Stone Mine

খননের নীতি

জমির মালিকরা সরকারের কাছে লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন করলে সরকারি অধিকর্তাদের পরিদর্শন এবং পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র সাপেক্ষে খননের লাইসেন্স মিলবে।

এ রাজ্যে খনিগুলি প্রধানত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়।

এ রাজ্যে খনিগুলি প্রধানত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৩৮
Share: Save:

পাথর, স্ফটিক বা খড়ির মতো অপ্রধান খনিজের খনন নিয়ে নতুন নীতি আনছে রাজ্য সরকার। মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতেও ওই সব খনিজ উত্তোলন করা যাবে। জমির মালিকরা সরকারের কাছে লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন করলে সরকারি অধিকর্তাদের পরিদর্শন এবং পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র সাপেক্ষে খননের লাইসেন্স মিলবে। এতে রাজ্যে অবৈধ খনির সংখ্যা কমবে, সরকারের রাজস্বও বাড়বে। আপাতদৃষ্টিতে এমন প্রস্তাব ন্যায্য বলে মনে হতে পারে। অবৈধ কারবারে রাশ টানা তো রাজ্য সরকারেরই কাজ। আর সরকারের আয় বাড়ানোও জরুরি, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। কিন্তু এই প্রস্তাবের প্রকৃত নৈতিকতা বিচার করতে হলে গিয়ে দাঁড়াতে হবে রাজ্যের অবৈধ পাথর খনি, অথবা খড়ি খাদানে। সে সব জায়গায় যে ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, এলাকার জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়, তাতে সন্দেহ জাগতে বাধ্য যে, এক টুকরো সরকারি কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেই কি সেই সমস্ত অন্যায়ের বিহিত হবে? বিহিত আদৌ হওয়া সম্ভব? সরকার লাইসেন্স দিয়ে দিলে অবৈধ খনি রাতারাতি বৈধ হতে পারে, কিন্তু যে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে রয়েছে অবৈধ খনি-খাদানে, তার কতটুকু পরিবর্তন হবে? বীরভূমে ২১০টি পাথর খাদানের মধ্যে দু’শোটিই অবৈধ। পুলিশ-প্রশাসন, পরিবেশ দফতর কী করে এতগুলো বছর এমন বেআইনি কারবার চলতে দিল, আগে সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা চাই। অনুমান করা চলে যে, এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর— সেই অবৈধ খনিগুলিকে বৈধতা দিলে প্রকৃত লাভ হবে কাদের।

রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ যারা অবাধে লুট করেছে, সেই দুর্বৃত্তদের শাসন না করে তাদের বৈধতা দিয়ে দায় সারলে ‘আইনের শাসন’ কথাটাই প্রহসন হয়ে ওঠে। এত দিন লাইসেন্স ছাড়াই যে সব খনি-খাদান মালিক অবাধে ব্যবসা করেছেন, আজ তাঁরা সরকারি লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত পূরণ করতে শ্রম আইন, পরিবেশ আইন, বা পরিবহণের বিধিনিষেধ মানতে শুরু করবেন, এ কথাও বিশ্বাস করা সহজ নয়। সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত খনি-খাদানে সরকারি কড়াকড়ি কতখানি, আর তাতে কতটুকু কাজ হয়, তা কয়লা খনি, বালি খাদান-সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা ভালই বোঝেন। এক-একটি খনি বা খাদানকে ঘিরে অপরাধের এমন এক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে যে, গ্রামবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়েছে। বাহুবলীরা অকাতরে টাকা বিলিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশকে বশে রাখে, এ কোনও গোপন কথা নয়। প্রশ্ন জাগে, তবে কি সেই প্রসাদ-প্রার্থীদের লাইনে এ বার যোগ দিল রাজ্য সরকারও? রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদে নিপীড়নের ব্যবস্থার গায়ে অনুমোদনের ছাপ দিলে তা আরও পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে না, তা নিশ্চিত হবে কী করে? এ প্রশ্ন বার বার করা চাই।

আক্ষেপ, এ রাজ্যে নীতি তৈরি হয় বিতর্ক-আলোচনা ছাড়াই, তাই প্রশ্ন করার সুযোগই মেলে না। অথচ, ব্যক্তিগত জমিতে খনি-খাদানের অনুমোদন কেন দিতে চায় সরকার, তার উত্তর দরকার ছিল। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তৃণমূল সরকারের স্পর্শকাতরতাই কি তার কারণ? সরকারি যে ঝুঁকি এড়াচ্ছে, তা দরিদ্র আদিবাসীদের ঘাড়ে চাপছে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এ রাজ্যে খনিগুলি প্রধানত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। সামান্য টাকা, অথবা নিয়োগের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আদিবাসীদের জমিতে খনি থেকে রিসর্ট, সবই গজিয়ে উঠছে। ইতিহাস দেখিয়েছে, আইনের দোহাই দিয়ে আদিবাসীদের জমিতে অন্যের দখলের প্রতিবাদে বার বার প্রবল আন্দোলন হয়েছে। ব্যক্তিগত জমিতে খননের বৈধতা আদিবাসীদের যদি আরও বিপন্ন করে, তবে সরকারের রাজস্ব বাড়লেও তাকে রাজ্যের লাভ বলা চলে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Stone Mine West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy