আইনের দুনিয়ায় ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ’-এর তাৎপর্য বিপুল। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রকমারি অভিজ্ঞানের যে ঘনঘটা রাজ্য জুড়ে, টাকার পাহাড়ের মতোই, ক্রমশ দৃশ্যমান, তাতে ‘পারিপার্শ্বিক’ শব্দটি এক অভূতপূর্ব মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। মন্ত্রিবরের অপরাধ এখনও প্রমাণিত নয়, সুতরাং তাঁকে অপরাধী বলা ব্যাকরণসম্মত হবে না। কিন্তু অভিযোগের ব্যাপ্তি ও গভীরতা রাজ্যের যে বিপুল ক্ষতি করছে, সে বিষয়টি অপরাধ প্রমাণ হওয়া অবধি ফেলে রাখলে ঘোর অন্যায় হবে। পার্থ অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী; মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসাবেও পরিচিত। ফলে, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির এমন ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠলে সেই অভিযোগটি শুধু ব্যক্তি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরিধিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন তোলে। সেই প্রশ্নের নিশানা এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও মাপে বড়— রাজ্য সরকার নামক যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা শাসক দল পাল্টে গেলেও গণতন্ত্রে যে প্রতিষ্ঠানটির আসন ধ্রুব— এই দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি সেই প্রতিষ্ঠানটিকেই আঘাত করছে। পার্থের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ ‘সাজানো’ হতে পারে, তাঁর গ্রেফতারিও কেন্দ্রীয় শাসকপক্ষের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হতে পারে— কিন্তু, যা-ই হোক না কেন, এমন অভিযোগ যে উঠতে পারছে, সেই কথাটিকেই তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হবে। এই ঘটনাটিকে প্রাত্যহিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেখতে পারা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে অপরিহার্য। সেই কাজে তিনি ব্যর্থ হলে তাঁর যে নৈতিক ক্ষতি হবে, কোনও রাজনৈতিক লাভই তা পূরণ করতে পারবে না।
আশঙ্কা, মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের শাসক দল সেই ব্যর্থতার পথে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন। দল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনাক্রমের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে জানিয়েছে যে, যাঁর বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হল, জবাবদিহির দায়ও তাঁরই, দলের বা সরকারের নয়। কিন্তু, পার্থবাবুর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়নি, দলের মহাসচিব পদেও তিনিই বহাল আছেন। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটি ভাষ্যও হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখনও অবধি যা হয়েছে, তাতে মনে হয় সবই যেন নিতান্ত স্বাভাবিক, যে কোনও অনৈতিকতার অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেস যে প্রতিক্রিয়া জানাতে অভ্যস্ত, এই ক্ষেত্রেও দল ঠিক সে পথেই চলেছে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় যে, পার্থবাবুর বিরুদ্ধে ওঠা এই ভয়ঙ্কর অভিযোগ রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে ক্ষতি করছে, মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দল সে বিষয়ে উদাসীন, এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার কোনও দায়িত্ব তাঁদের আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। কোনও এক জন বা একাধিক মন্ত্রীর দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকার সংবাদের চেয়ে এই সত্যটি রাজ্যের পক্ষে অনেক বেশি মারাত্মক। এই গ্লানি অনেক বেশি পীড়াদায়ক। অতীব দুর্ভাগ্যের কথা যে, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল রাজ্যবাসীকে এই পীড়ার মধ্যে নিক্ষিপ্ত করেছে।
ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতির দায় ঝেড়ে ফেলার পন্থাটি সময়-পরীক্ষিত। পার্থবাবুর গ্রেফতার হওয়া বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও মন্তব্য এখনও শোনা যায়নি, তবে দলের বার্তায় স্পষ্ট, তাঁরা মনে করছেন যে, এই দুর্নীতির অভিযোগের দায় দলের নয়, ব্যক্তিবিশেষের। কথাটি বিপজ্জনক। এবং ভিত্তিহীন, তাই অসত্য। দলের সঙ্গে যুক্ত যে কোনও ব্যক্তির আচরণের দায় দলকে নিতেই হয়, যেমন দলভুক্ত ব্যক্তির কৃতিত্বও দলের উপর বর্তায়; পার্থবাবুর মতো প্রথম সারির নেতা-মন্ত্রীর ক্ষেত্রে তো বটেই। এত বড় দুর্নীতির কথা যদি দলনেত্রী বা দল না জেনে থাকেন, তবে সে ব্যর্থতা ভয়ঙ্কর। যদি জেনে থাকেন, এবং জেনেও নিশ্চুপ থেকে থাকেন, তা হলে দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর। আজ কিন্তু দায় এড়ানোর কোনও উপায় নেই। দল ও দলনেত্রী হয়তো তা টের পাচ্ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy