সমাজমাধ্যম যে এ-যুগে কত পাল্টে দিয়েছে রাজনৈতিক চালচিত্রকে, আবারও তার প্রমাণ পাওয়া গেল— বাংলাদেশে। বলা যায়, শেখ হাসিনা তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হল সমাজমাধ্যমের কারণেই, এ হয়তো অতিকথন। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে প্রায় বিরোধীশূন্য পরিস্থিতিতে জয়লাভ, এক প্রকার নির্বাচনী আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা, শাসনতন্ত্রের প্রতিটি স্তরে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি-সহ অনেক কারণই উঠে আসবে যা কেবল রাজনৈতিক ভাবে বিরোধীদেরই নয়, দেশের সাধারণ মানুষের সরকার-বিরোধিতাকে পুঞ্জীভূত করেছে। এই কাজেই ধার-ভার জুগিয়েছে সমাজমাধ্যম— অসন্তোষকে ভাষা দিয়েছে, প্রতিবাদকে দিয়েছে বিপুল পরিসর, এবং পরিস্থিতির তুঙ্গমুহূর্তে তার তাৎক্ষণিকতা ও দ্রুতিকে উজাড় করে দিয়েছে প্রতিবাদী জনতাকে সংগঠিত করার কাজে। সমাজমাধ্যমের জেরে না হোক, সমাজমাধ্যমের জোরে যে এ কাজের বড় একটা অংশ সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের, কিংবা উপরমহলের যে কোনও অন্যায় অবিচার অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে এই যে একটা সমষ্টিগত চেহারা দিতে সমাজমাধ্যম, তার প্রধান কারণ তার প্রযুক্তিগত ক্ষমতা: এক মুহূর্তেই কোনও তথ্য, খবর, ঘটনাকে লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে হাজির করার সামর্থ্য। এতে দু’টি স্তরে কাজ হয়— প্রথম স্তরে অসন্তোষ ও প্রতিবাদ ভাষা পায় সমাজমাধ্যমেই, দ্বিতীয় স্তরে তা নেমে আসে বিরাট জনস্রোতের রূপ ধরে রাস্তায়। গোড়ার স্তরটি অদৃশ্য হলেও জনমত সংগঠনে ব্যাপক প্রভাব পেলে, আর দ্বিতীয় স্তরের দৃশ্যমানতা শাসকেরও ভিত কাঁপিয়ে দেয়। শুধু বাংলাদেশ বলেই নয়, সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের নানা দেশে যে যে গণবিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে সেখানেই দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমের জোর— আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে, ভারতে কৃষক আন্দোলনে, ইউরোপের নানা দেশে সরকারের শরণার্থী নীতির প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের পথে নেমে আসায়, সিএএ-এনআরসি’র প্রতিবাদে দিল্লির শাহিনবাগে। দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ডে সমাজমাধ্যমে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ কী ভাবে পরবর্তী ঘটনাক্রমকে চালিত করেছিল সেই উদাহরণ চোখের সামনেই, গত সপ্তাহে কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে ‘অন-ডিউটি’ ডাক্তার-ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের সাম্প্রতিকতম ঘটনায় এরই মধ্যে সমাজমাধ্যমে যে হতাশা, ক্রোধ ও বিক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, রাজ্য প্রশাসন তা উপেক্ষা করলে নিতান্ত ভুল করবে।
সমাজমাধ্যমের প্রযুক্তিগত চরিত্র তার সবচেয়ে বড় শক্তি, আবার বিরাট মাপের দুর্বলতাও। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ছড়িয়ে পড়ে অসত্য, ভুয়ো তথ্য, খবর, উস্কানি, দাঙ্গার প্ররোচনা— যা হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের ঘটনায় এই উদাহরণও কম নয়। প্রতিবেশী দেশ অবধি যেতে হবে না, এই ভারতে বিজেপির ‘আইটি সেল’ ধর্মীয় রাজনীতির উস্কানিতে সমাজমাধ্যমের ব্যবহার যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তার কুপ্রভাবে নাগরিকের রোজকার স্বাভাবিক সমাজজীবনও গ্রস্ত। আজকের নাগরিকদের কাঁধে তাই বড় দায়িত্ব। সমাজমাধ্যমের মতো অসীম ক্ষমতাধর অস্ত্রটি হাতে আছে বলে তার প্রতিবাদের পথটি সহজ বটে, তা বলে সেটির প্রয়োগের সঙ্গে অপপ্রয়োগও প্রবল— এই অত্যন্ত জরুরি কথাটি মাথায় রাখতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy