ইদানীং একটি মেসেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। তার উৎস অজ্ঞাত, তবে তার পিছনে অতিসক্রিয় আইটি সেলের ভূমিকা থাকা আশ্চর্যের নয়। মেসেজটির বয়ান হল, অমর্ত্য সেন যে শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের কথা শতমুখে বলতেন, তার অর্থনীতির এমন হাঁড়ির হাল হল কী করে? অধ্যাপক সেন এই প্রশ্নের জবাব দেননি, কিন্তু অন্য দুই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থশাস্ত্রী দুই ভিন্ন পরিসরে দিয়েছেন। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু এই সংবাদপত্রেই একটি সাক্ষাৎকারে (‘শিক্ষায় বৈষম্য অসহনীয়’, ১৯-৭) বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কার পতনের অন্যতম কারণ হল, সে দেশে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন সম্প্রতি বললেন, সংখ্যালঘুদের নিশানা করে বেকারত্বের সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করলে এমনই ঘটে। ভারতের তুল্য আয়ের দেশ হয়েও যে শ্রীলঙ্কা এক সময় সামাজিক ক্ষেত্রের মাপকাঠিগুলিতে বহু এগিয়ে ছিল, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতা তাকে বিপন্ন করেছে। কার্যত নিখরচার মোবাইল ডেটার ভরসায় যাঁরা অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক প্রজ্ঞাকেও প্রশ্ন করতে দ্বিধা করেন না, কৌশিক বসু বা রঘুরাম রাজনের কথায় তাঁরা কর্ণপাত করবেন, এই মহা-ভারতে তেমন ভরসা নেই। কিন্তু, ‘ভক্তি’ যাঁদের জ্ঞান বা বুদ্ধিকে এখনও আচ্ছন্ন করেনি, এই কথায় তাঁদের বিচলিত হওয়ার কথা। কারণ, এই বিপদ শুধু শ্রীলঙ্কারই নয়, এই বিপদ ভারতেরও। গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান, বা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণুতা, গ্রহণশীলতা— কোনও মাপকাঠিতেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতকে উজ্জ্বল বলার উপায় নেই।
রাজন মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করলে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, বিবাদ বাড়ে— তার প্রত্যক্ষ ফল পড়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের উপর। কেন, তার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথম কথা, বিনিয়োগ খোঁজে রাজনৈতিক সুস্থিতি— যে দেশে সর্বদাই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপড়েন চলে, বা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী দমিয়ে রাখতে চায় অপেক্ষাকৃত ক্ষীণবল জনগোষ্ঠীকে, সেই দেশ কার্যত আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনও সময় সংঘাতের অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে পারে। লগ্নিকারীরা সেই ঝক্কিতে নিজেদের পুঁজিকে জড়াতে চান না। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ নির্ভর করে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের উপর, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব তাকেও প্রভাবিত করে। কেউ বলতে পারেন, ‘গণতন্ত্রের আধিক্য’ উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করে দেয়— তাকে গতিশীল করতে প্রয়োজন কোনও বজ্রমুষ্টিসম্পন্ন ‘বিকাশপুরুষ’-এর। তেমন কোনও নেতায় যে পুঁজি আপত্তি করে না, চিন তার মোক্ষমতম প্রমাণ। রাজন মনে করিয়ে দিয়েছেন, গণতন্ত্রহীনতা শেষ অবধি অর্থব্যবস্থার পতনই ডেকে আনে।
নিপীড়ন, সংখ্যালঘুদের অধিকারহানি, গণতন্ত্রহীনতা, সাঙাততন্ত্র কেন অর্থব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক, তার আরও একটি— সম্ভবত বৃহত্তম— কারণ নিহিত আছে বিশ্বাসের প্রশ্নে। যে কোনও অর্থব্যবস্থারই মূল চালিকাশক্তি পারস্পরিক বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের ভরসাতেই প্রতি পদে আইনি চুক্তি রচনা না করেও ব্যবসায়িক কাজকর্ম চালিত হয়, লেনদেন ঘটে। যে দেশে সর্বদাই একটি চোরা হিংস্রতা প্রবহমান, সে দেশে পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিমাণ কম হওয়াই স্বাভাবিক। দুনিয়ার অর্থব্যবস্থাগুলিকে যদি চড়া বিশ্বাস ও নিম্ন বিশ্বাসের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, চড়া বিশ্বাসের দেশগুলি আর্থিক ভাবে অনেক ভাল করেছে। ভারতের বর্তমান পরিচালকরা যদি বোঝেন যে, সংখ্যালঘু-দমনের অত্যুৎসাহে তাঁরা অর্থব্যবস্থার কোমর ভেঙে দিচ্ছেন, তা হলে মঙ্গল। দেশবাসী যদি কথাটি বোঝে, তা হলে আরও ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy