Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
West Bengal Legislative Assembly

খবরদার!

হাঁড়ির একটি ভাত টিপেই নিশ্চিত হওয়া যায়, সংসদে এই সব শব্দ ব্যবহার করা হলে কার বা কাদের গায়ে লাগে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২২ ০৭:৩৩
Share: Save:

অসংসদীয় শব্দের নতুন ফর্দ ভাল করে মুখস্থ হওয়ার আগেই সাংসদরা জানলেন, সংসদ চত্বরে তাঁদের প্রতিবাদী আয়োজনগুলিও আর চলবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কথা এবং কাজের স্বাধীনতাকে যত দূর সম্ভব মর্যাদা দেওয়া হবে, গণতন্ত্রে এটাই প্রত্যাশিত। সেই স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা যদি বড় রকমের গোলযোগ বাধান, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁদের সংযত করা আবশ্যক, কিন্তু সে জন্য পাইকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করার কোনও সুযুক্তি থাকতে পারে না। তেমন নির্দেশের অর্থ একটাই: শাসকরা বিরোধীদের সমস্ত প্রকারে দমন করতে তৎপর। সংসদ চত্বরে বিক্ষোভ প্রতিবাদের যে ধারা এ দেশে প্রচলিত, সেটি নিতান্তই শান্তিপূর্ণ অহিংস রাজনীতির প্রকরণ। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি নীতি, সিদ্ধান্ত ও আচরণের সমালোচনা বা নিন্দা জানাতে বিরোধীরা সেই প্রকরণ ব্যবহার করেন, তাতে কোনও গোলযোগ, অশান্তি বা সংঘর্ষ হয় না, কেবল দেশের দশের চোখে সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ কিঞ্চিৎ মলিন হয়। বর্তমান শাসকদের সহিষ্ণুতার মাত্রা এমনই যে, সেটুকুও তাঁরা মেনে নিতে রাজি নন। অতএব আদেশ শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে: অবস্থান, ধর্না, অনশন, বিক্ষোভ, সব বন্ধ!বিচিত্র অসহিষ্ণুতার পরিচয় মিলেছে নতুন শব্দতালিকাতেও। অসংসদীয় শব্দের ইতিহাস প্রাচীন। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে অনেক কাল আগেই ব্যক্তিগত আক্রমণে রাশ টানতে ‘অশিষ্ট’ শব্দ-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালু হয়েছিল, সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকে সেই নিয়ন্ত্রণ বিধিবদ্ধ হতে থাকে, কালক্রমে ‘আনপার্লামেন্টারি’ অভিধাটি বৃহত্তর সমাজেও সুপ্রচলিত হয়। ওয়েস্টমিনস্টারের এই ধারাটিই স্বাধীন ভারতের সূচনা থেকে সংসদ ও বিধানসভায় প্রবাহিত হয়। ক্রমাগত নতুন নতুন শব্দ ও তার প্রয়োগ সংসদের অনুপযুক্ত বলে নির্ধারিত হতে থাকে। গত শতকের শেষে তৈরি করা হয় সেই সময় অবধি নির্ধারিত সমস্ত অসংসদীয় শব্দের তালিকা। আকারে মহাভারতপ্রমাণ সেই অতিকায় গ্রন্থের নতুন সংস্করণ প্রণীত হয় ২০০৯ সালে, তার পরেও নিয়মিত তার ভান্ডারে নানা অমূল্য রতন জমা হয়ে আসছে। যেমন, হিটলার, মুসোলিনি এবং রাবণের সঙ্গে সেখানে স্থান পেয়েছে আলিবাবা ও চল্লিশ চোরও! কিন্তু অধুনা যে শব্দগুলি অবাঞ্ছিতের তালিকায় ঢুকেছে, তাদের বিশেষত্ব অন্য মাত্রার। ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত সেই সব শব্দের পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, উদাহরণ হিসাবে কেবল একটির উল্লেখ করা যেতে পারে: জুমলাজীবী। হাঁড়ির একটি ভাত টিপেই নিশ্চিত হওয়া যায়, সংসদে এই সব শব্দ ব্যবহার করা হলে কার বা কাদের গায়ে লাগে। এবং বুঝে নেওয়া যায়, কোনও সামাজিক আলোচনা বা সওয়াল-জবাবের মধ্য দিয়ে এই শব্দগুলিকে অসংসদীয় বলে সাব্যস্ত করা হয়নি, খুঁজে খুঁজে বেছে বেছে এগুলিকে তুলে এনে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।প্রশ্ন সেখানেই। ক্ষমতাবানের গায়ে লাগলেই বা তাঁদের মহিমায় টোল পড়লেই সংসদীয় মহাভারত অশুদ্ধ হবে, এটা কি গণতন্ত্রের নিয়ম হতে পারে? কিন্তু এ কেবল শাসকের অসহিষ্ণুতা নয়, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের অভাবও বটে। প্রকৃত আত্মপ্রত্যয় যে নেতাদের থাকে, তাঁরা এ-ধরনের নিন্দা বা ব্যঙ্গসূচক শব্দে বিচলিত হন না, তাকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করেন অথবা সকৌতুকে উড়িয়ে দেন। ভারতে তেমন প্রত্যয়ী নেতা বিরল ছিলেন না, এমনকি নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক শিবিরেও তাঁদের দেখা গিয়েছে। কিন্তু তাঁরা আজ অতীত। আজ যাঁরা শাসকের গদিতে, তাঁদের ছাতির মাপ যা-ই হোক না কেন, আসলে তাঁরা নিতান্তই ‘ফাঁকা মানুষ’। সর্বদাই তাঁদের মনে দুশ্চিন্তা, এই বুঝি দাপটে গ্রহণ লাগল! অতএব বিরোধীর মুখ বন্ধ করতে হবে, প্রতিবাদ বিক্ষোভে কুলুপ আঁটতে হবে। সংসদ ব্যাপারটাকেই তুলে দিতে পারলে ভাল হত, কিন্তু গণতন্ত্র বড় বালাই।

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Legislative Assembly Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy