Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
TMC

ক্ষমতাসাগরমন্থন

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে না। এ ঘোর কলিতে তাকে নাড়ানোর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়, তাতেও অনেক সময় কাজ হয় না, সেই কল অবিচল থেকে যায়।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২২ ০৪:৫৩
Share: Save:

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে না। এ ঘোর কলিতে তাকে নাড়ানোর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়, তাতেও অনেক সময় কাজ হয় না, সেই কল অবিচল থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমান শিল্পমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রবীণ পদাধিকারী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল, তাঁকে বুধবার সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে সিবিআই দফতরে হাজির হতে হবে, তিনি উপস্থিত হয়েছেন প্রায় পৌনে ছ’টায়। ধর্মের কল নড়েছে, অথবা নড়তে বাধ্য হয়েছে। শাসক দলে ও মন্ত্রিসভায় পার্থবাবুর সহকর্মী পরেশ অধিকারীর যাত্রায় অবশ্য দেখা গেল পৃথক ফল। রাজ্যের শিক্ষা দফতরের এই প্রতিমন্ত্রীকে মঙ্গলবার রাত্রি আটটার মধ্যে সিবিআইয়ের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিরা। তিনি নাকি মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতার ট্রেনে চড়েছিলেন। স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল, ধর্মের কল দেরিতে হলেও নড়বে, তিনি অন্তত বুধবার তদন্তকারীদের সামনে পৌঁছবেন। পৌঁছননি। ট্রেন কলকাতায় এসেছে, মন্ত্রী আসেননি। এখন তাঁকে খুঁজে বার করার জন্য সিবিআইকেই দায়িত্ব দিতে হবে কি না, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো সে-কথা বলতে পারবেন। অবশ্য তিনি হয়তো ঝাঁঝিয়ে উঠবেন: বলতে পারি, কিন্তু কেন বলব?

জল্পনা থাকুক। আপাতত মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, যারা কুকর্ম করে, তাদের মানুষ ভালবাসে না, তিনিও ভালবাসেন না। লক্ষণীয়, একই দিনে তাঁর দলের মুখপাত্রের উক্তি: রাজ্যে স্বচ্ছতার সঙ্গে জনমুখী প্রকল্পের কাজ চলছে, ৯৯ শতাংশ ভাল কাজ হচ্ছে। অর্থাৎ, এই এক শতাংশ খারাপ কাজের কাজিদের মানুষ ভালবাসবে না, মুখ্যমন্ত্রীও না। ধর্মের কল তাদের শাস্তি দেবে। প্রশ্ন একটাই। ভাল আর খারাপের এই তুলনামূলক পরিসংখ্যানগুলো কোথা থেকে পাওয়া গেল, আর কেনই বা রাজ্যের লোক সেগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে? শুধুমাত্র স্কুল শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ব্যাপারটি নিয়েই যে ব্যাপক এবং গভীর গরমিলের অভিযোগ উঠেছে, আদালত যে ভাবে সেগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছে, রাজ্য সরকারের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সিবিআইকেই ছাড়পত্র দিয়েছে, তাতে তো এই ধারণাই স্বাভাবিক যে, তুলনামূলক পরিসংখ্যানটি আসলে উল্টো মেরুর কাছাকাছি— ভাল ১ শতাংশ, খারাপ ৯৯ শতাংশ!

পরিসংখ্যানের কচকচি থাকুক, ভালবাসার কথাও নাহয় আপাতত তোলা রইল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার বা তার শাসক দল যদি তার প্রথম ও প্রধান কাজ রাজধর্মের প্রতি এক শতাংশ মর্যাদার প্রমাণ দিতে চায়, সরকার ও দলের নায়কনায়িকারা যদি নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতার এক শতাংশও পুনরুদ্ধার করতে চান, তবে তাঁদের প্রথম কর্তব্য হবে: অকপটে এবং স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করা যে, দুর্নীতির ব্যাধি বহু দূর অবধি বিস্তৃত হয়েছে, এবং দ্বিতীয় কর্তব্য: সেই ব্যাধি নির্মূল করার জন্য একশো শতাংশ তৎপর হওয়া। এই গোলযোগের মূলে কিছু দুষ্টু লোকের বিচ্ছিন্ন অপরাধ, অথবা কোনও কন্যাস্নেহে অন্ধ পিতার কাহিনি— এই সব ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করার মতো লোক সম্ভবত শাসক দলের অন্দরমহলেও বিরল। হরিণ বিপদে পড়লে নিজের মুখখানি লুকিয়ে নিরাপদ বোধ করে কি না, প্রাণী-আচরণ বিশারদরা বলবেন। কিন্তু শাসকরা তেমন মনোভাবের শিকার হলে রাজ্যের সমূহ সর্বনাশ, সর্বনাশ তাঁদেরও। মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি, দুর্নীতির জাল এত দূর ছড়িয়েছে যে, হয়তো সাফাইয়ের চেষ্টা করলে ক্ষমতাদরিয়ায় বিরাট আলোড়ন ঘটবে, সমুদ্রমন্থনে গরল উঠবে, বহু ডানা ছাঁটতে হবে— কিন্তু সেই পরিণাম সহ্য করার সাহস না থাকলে নেতৃত্ব ও প্রশাসন উভয়েরই মহাসঙ্কট আসন্ন। সে দিক থেকে, শিক্ষা-কেলেঙ্কারি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, এবং সম্ভবত—আত্মশুদ্ধির এক বিরাট সুযোগও।

অন্য বিষয়গুলি:

TMC West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy