—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ছোটবেলায় নিপীড়নের শিকার হলে বড় হয়ে ইন্টারনেটের নেশায় মগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই ধারণা উঠে এসেছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের এক শিক্ষকের নেতৃত্বে এবং পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া-র গবেষকদের সহযোগিতায় সম্পন্ন এক সমীক্ষায়। আঠারো থেকে পঁচিশ বছর বয়সি প্রায় তিনশো তরুণতরুণীর অতীত ও বর্তমানের খোঁজ নিয়েছেন সমীক্ষকরা। তাঁদের সিদ্ধান্ত: যারা শৈশবে বারংবার ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে, তাদের নেট-দুনিয়ায় নেশাগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় অনেকটা বেশি। বিশেষত, শিশুকালে যৌন নিপীড়নের ঘটনা এক বার ঘটে থাকলেও পরে অনুরূপ প্রবণতা দেখা দেয়। এই ধরনের সমীক্ষা কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নিয়ে সব সময়েই সংশয় থাকে। মাত্র কয়েকশো মানুষের উপর সমীক্ষা চালালে সেই সংশয় আরও জোরদার হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমীক্ষা যে বিষয়টিকে জনপরিসরে তুলে এনেছে, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা আরও বড় আকারে এবং আরও গভীর ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবেন, এমনটাই কাম্য ও প্রত্যাশিত।
অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির যৌথ প্রভাবে বা তাড়নায় সমাজ দ্রুত বদলাচ্ছে, অনিবার্য ভাবেই সেই পরিবর্তনের বিপুল প্রভাব পড়ছে শিশু, কিশোর ও তরুণদের উপর। পরিবর্তনের নানা রূপ সমাজের সর্বস্তরে প্রতিনিয়ত প্রকট। নেট-আসক্তি তার একটি বহুলপরিচিত এবং ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত রূপ। তার কত শতাংশ শৈশবে নিপীড়ন বা লাঞ্ছনার পরিণাম, তা নিয়ে তর্ক ও গবেষণা চলতেই পারে, কিন্তু এমন কথা মনে করার প্রভূত কারণ আছে যে, নিপীড়ন এবং আসক্তি, দুইয়ের পিছনেই সমাজের এক গভীর ব্যাধি অনেকাংশে দায়ী। সেই ব্যাধি এক অর্থে বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি। বিচ্ছিন্নতা কার্যত সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী। বহু মানুষের জীবনে পারিবারিক কাঠামোয় পুরনো যোগসূত্রগুলি বহুলাংশে ছিন্ন হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে এবং বহু ক্ষেত্রে তার থেকেও অনেক বেশি প্রবল ভাবে ছিন্ন হয়েছে পুরনো প্রতিবেশের সংযোগ— ‘পাড়া’ কথাটিই সেখানে কার্যত অচল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা এই সমাজকে গ্রাস করেছে আরও ব্যাপক এবং গভীর অর্থেও। ব্যক্তিমানুষ তার জীবনের নানা পরিসরে প্রায়শই অন্যের সঙ্গে স্বাভাবিক সংযোগ খুঁজে পায় না, পারস্পরিক যোগাযোগ পরিণত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের যান্ত্রিকতায়। পারিবারিক স্তরে, এমনকি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিসরেও এই প্রবণতা উত্তরোত্তর তীব্রতর হয়ে চলেছে।
এই প্রবণতাকে ‘অবক্ষয়’ বা ‘বিকৃতি’ গোছের অভিধা দিয়ে নিন্দা করে লাভ নেই, কিন্তু তার বাস্তব পরিণামগুলিকে বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। একটি পরিণাম এই যে, শিশুরা ক্রমশই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বড় রকমের মাসুল গুনতে বাধ্য হচ্ছে। নিপীড়ন বা লাঞ্ছনা তার একটি দিক। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শিশুরা অতীতেও নিপীড়িত বা লাঞ্ছিত হয়েছে— দুর্বলের উপর সবলের উপদ্রব এক কালজয়ী ব্যাধি। বিশেষত পারিবারিক বা প্রাতিবেশিক পরিসরে যৌন নিপীড়নের অজস্র কাহিনি সামাজিক অনুশাসনের ঘেরাটোপে গুমরে মরেছে, বাইরের পৃথিবীতে সেই যন্ত্রণা প্রকাশও পায়নি। কিন্তু আজকের শিশুরা অনেকেই যে নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিন কাটায়, তা ওই যন্ত্রণায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। কেবল প্রত্যক্ষ নিপীড়নের অভিজ্ঞতা নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিচ্ছিন্নতা নিজেই এক গভীর এবং স্থায়ী বেদনার কারণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে তাদের ‘আশ্রয়’ হয়ে দাঁড়ায় হাতের মুঠোয় ধরা ছোট্ট যন্ত্রটি, যার পর্দায় তার কাছে ধরা দেয় অনন্ত বিনোদনের পসরা। যে শিশুকে তার একাকিত্বের প্রতিষেধক বা প্রলেপ হিসাবে হাতে একটি মোবাইল ধরিয়ে দেওয়া হয়, অতি দ্রুত ওই যন্ত্রটি কী ভাবে তার মনোভুবনকে গ্রাস করে ফেলে, তা আজ সর্বজনবিদিত। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই অনেকের মন ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাকেই বরণ করে নেয়, বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বেই স্বস্তি পায়, অন্য মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক সংযোগ তার কাছে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। বহু শিশু কিশোর তরুণের পারস্পরিক যোগাযোগের ভুবনটি এখন ইন্টারনেটের পরিসরেই স্থানান্তরিত হয়েছে। এক বিচিত্র দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় অনন্ত ও অবিরত সংযোগের প্রযুক্তিই হয়ে উঠেছে অপার বিচ্ছিন্নতার ধারক ও বাহক। স্বভাবতই, যে শিশু কোনও যন্ত্রণাদায়ক বা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার হয়, তার কাছে এই সংযোগহীন সংযোগের আকর্ষণ আরও বেশি প্রবল হয়ে উঠতে পারে। সমীক্ষার রিপোর্টে এই সত্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy