মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলন। ফাইল চিত্র।
কলকাতা হাই কোর্ট প্রশ্ন করেছে, মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মীদের মিছিলের অনুমতি পাওয়ার জন্য বার বার আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে কেন? প্রশ্নটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, এবং প্রকৃত প্রস্তাবে তা বর্তমান আন্দোলনের মাপের চেয়ে বড়। ভারতের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারকে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকার করা হয়েছে। কোনও সংগঠন, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষ বিনা বাধায় সরকারের বা রাষ্ট্রের যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন, নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন। আদালতের প্রশ্ন, তা হলে কেন সরকারি কর্মীদের শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিলের অনুমতি দেবে না পুলিশ-প্রশাসন? যে মিছিলটিকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন উঠেছে, তাকে অনুমতি না দেওয়ার কারণ হিসাবে রাজ্য সরকার যে যুক্তি পেশ করেছে, এক কথায় তা হল, এই মিছিলের ফলে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হবে। আদালত পাল্টা প্রশ্ন করেছে যে, অন্যান্য মিছিল বা সমাবেশের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটে না? রাজ্য সরকারের যুক্তিটি অন্তঃসারশূন্য, কিন্তু শুধু সেটুকুই নয়। সরকারের এই যুক্তি সংবিধানের বৈষম্যহীনতার মৌলিক অধিকারকেও খণ্ডন করে। ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, এই ক্ষেত্রে যে-হেতু কর্মীদের ক্ষোভ প্রত্যক্ষ ভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, সরকার যে কোনও প্রকারে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঠেকাতে চায়। কিন্তু, তার জন্য যদি সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার খণ্ডন করতে হয়, তা হলে গণতন্ত্রের প্রতি, এবং তার ভিত্তিপ্রস্তর সংবিধানের প্রতি গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকারের অশ্রদ্ধা অতি প্রকট হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতি কখনও কাম্য হতে পারে না।
কেউ এক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন যে, বকেয়া মহার্ঘ ভাতা আদায়ের জন্য যখন আদালতে মামলা চলছেই, তখন আবার মিছিলের মতো বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রয়োজন কী? সেই কর্মসূচি কি তবে বিচারব্যবস্থার উপর অনাস্থারই প্রকাশ নয়? এ ক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বিধেয় যে, মামলা এবং আন্দোলন গণতন্ত্রের দু’টি পৃথক পরিসরে কাজ করে। মামলার উদ্দেশ্য, বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হয়ে বুঝে নেওয়া যে, সংশ্লিষ্ট দাবিটি সংবিধানসিদ্ধ কি না, এবং তা হলে সরকারকে আইনত সেই সাংবিধানিক পথে চলতে বাধ্য করা। অন্য দিকে, মিছিল বা বিক্ষোভ অবস্থান সম্পূর্ণত রাজনৈতিক কর্মসূচি, যার লক্ষ্য সরাসরি আইনবিভাগের উপর চাপ তৈরি করা, সরকারের কাছে জনমতের প্রদর্শন। একটি পরিসর অন্যটির প্রয়োজনীয়তা খর্ব করে না, বৈধতাও হনন করে না। আদালতের কাজ আইনের পরিসরে বিচার করা; কিন্তু, প্রত্যক্ষ জন-আন্দোলনের কাজ, প্রয়োজনে আইন পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বিধেয় যে, সরকারি কর্মীদের আন্দোলনের অধিকারকে সমর্থন করা মানেই তাদের দাবির ন্যায্যতা স্বীকার করে নেওয়া নয়। দু’টি প্রশ্ন যে ভিন্ন, এই কথাটিকে বিস্মৃত হতে দেওয়া চলে না।
আন্দোলনের পদ্ধতি হিসাবেও বন্ধ বা ধর্মঘটের সঙ্গে মিছিল বা অবস্থান বিক্ষোভের ফারাক রয়েছে। বন্ধ বাধ্যতামূলক ভাবে বৃহত্তর জনসমাজের কাজে বাধাদান করে— বস্তুত, সেই বাধা দেওয়াই বন্ধের উদ্দেশ্য। মিছিলের ফলে জনজীবনে প্রভাব পড়বে কি না, অথবা সেই প্রভাবকে যথাসম্ভব কম করা যাবে কি না, তা বহুলাংশে নির্ভর করে পুলিশ-প্রশাসনের উপর। আদালতও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, প্রয়োজন বোধে প্রশাসন মিছিলের উপর বিবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। সেই বিধিনিষেধের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনজীবন মসৃণ রাখা। সেই দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু, সেই দোহাই দিয়ে নাগরিকের সংবিধানসিদ্ধ অধিকার হরণ করা চলে না। এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়। গোটা দেশেই তা ক্রমবর্ধমান— দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভ ঠেকাতে একাধিক বার এই পথেই হেঁটেছিল প্রশাসন। কিন্তু, অন্যত্রও গণতন্ত্রের অভাব, এই অজুহাতে রাজ্যের লজ্জা ঢাকা পড়বে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy