Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
TMC

বিপত্তারিণী

এমন সুরক্ষা কবচ নাগরিককে কতটা ভরসা দেবে, সেই সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকার এবং দলের সর্বাধিনায়িকা বলেই সংশয়টি আরও জোরদার হয়ে ওঠে

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৩
Share: Save:

সরকারি প্রকল্পের সুফল নাগরিকদের কাছে যাতে ঠিক ভাবে পৌঁছয়, সেই উদ্দেশ্যে মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েত সদস্য এবং শাসক দলের নেতা-কর্মীরা দু’কোটি পরিবারের কাছে যাবেন, মানুষের কথা শুনবেন, অভাব-অভিযোগের প্রতিকারে সচেষ্ট হবেন— সাধু উদ্যোগ। বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচির বাস্তব রূপায়ণ নিয়ে বরাবরই এবং সব রাজ্যেই নানা অভিযোগ ওঠে। ত্রুটিবিচ্যুতির অভিযোগ, ঘাটতির অভিযোগ, দুর্নীতি বা অনাচারের অভিযোগ। অধুনা পশ্চিমবঙ্গে তেমন অভিযোগের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের উঁচু তলার প্রতিনিধিরা গ্রামেগঞ্জে গেলে নাগরিকরা সরাসরি তাঁদের মুখের উপর নালিশ করছেন, প্রশ্ন তুলছেন। বিশেষত, আবাস যোজনার প্রাপক তালিকা নিয়ে বেনিয়মের বিপুল অভিযোগ উঠেছে এবং সরকার কার্যত তার অনেকখানি স্বীকার করে নিয়েছে। কেন্দ্রের চাপে বিপুল আকারে তালিকা সংশোধন চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শাসক দল প্রতিনিধি পাঠিয়ে গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগ জানতে চাইছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন বেকায়দায় না পড়লে কি শাসকের টনক নড়ত? উঠতে পারে জটিলতর প্রশ্নও: বিরোধিতা বা সমালোচনার পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি সরকার নিজে থেকে ঘরে-ঘরে লোক পাঠানোর কৌশল করেছে? প্রশ্নগুলি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু যে কারণেই হোক, শাসকরা নাগরিকের কথা শুনতে চাইছেন, এই কর্মসূচি তাঁদের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবেই গণ্য হতে পারে।

কিন্তু সেই কর্মসূচির নাম ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কেন? পশ্চিমবঙ্গের অনেক নাগরিকই অবশ্য আজ আর এই প্রশ্ন তুলবেন না, কারণ এক দশক পার হয়ে প্রায় এক যুগের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তাঁরা জেনে গিয়েছেন, বর্তমান সরকার বা শাসক দলের সমস্ত পদক্ষেপই দিদি তথা মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় চালিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, দলনেত্রী, সরকারের প্রধান, কিন্তু তাঁকে ঘিরে যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বাতাবরণ দীর্ঘদিন যাবৎ তৈরি করা হয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়। অথচ এখন এ দেশে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এতটাই প্রচলিত হয়েছে যে, কোভিড প্রতিষেধকের শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবির মতোই দলীয় জনসংযোগ কর্মসূচির শিরোনামে দিদির সুরক্ষা কবচও অনেকের কাছে হয়তো নিতান্ত স্বাভাবিক বলেই বোধ হবে। নেতা বা নেত্রীর প্রতিমা যেন নিজগুণেই বিপত্তারিণী।

এমন সুরক্ষা কবচ নাগরিককে কতটা ভরসা দেবে, সেই সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকার এবং দলের সর্বাধিনায়িকা বলেই সংশয়টি আরও জোরদার হয়ে ওঠে। বিচক্ষণ নাগরিক প্রশ্ন তুলতেই পারেন— এমন কবচের দরকার হচ্ছে কেন? অতীতে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি ঘোষণার পরেও এই প্রশ্ন উঠেছিল। সরকার তথা প্রশাসন যথাযথ ভাবে কাজ করলে, বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করলে এমন বিপত্তারিণী ব্রত পালনের প্রয়োজন হয় না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে যদি বারংবার ‘আমি আছি সব মুশকিল আসান’ ঘোষণা করে সমগ্র রাজ্যের নাগরিককে অভয়বাণী শোনাতে হয়, হাজার-হাজার প্রতিনিধিকে ‘দিদির দূত’ হয়ে এবং তাঁর লেখা চিঠি হাতে নিয়ে দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরতে হয়, তা হলে কি প্রশাসনের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয় না। সেই ব্যর্থতার দায় কি শেষ অবধি তার সর্বাধিনায়িকার উপরেই বর্তায় না? দেহের সমস্ত রক্ত মুখমণ্ডলে জমা হওয়া যেমন সুস্বাস্থ্যের পরিচায়ক নয়, একা এবং অদ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রীই যদি সব সমস্যার একমাত্র ভরসা হিসাবে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে চলেন, তবে বুঝতে হয়, প্রশাসনের অবয়বটিতে অতীব কঠিন ব্যাধির আক্রমণ ঘটেছে। শরীর ব্যাধিগ্রস্ত হলে মুখমণ্ডলও কিন্তু রেহাই পায় না।

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Mamata Banerjee Panchayat Poll
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy