আই গো আপ— অর্থাৎ কিনা, গরুর চোখে জল। অর্থাৎ, গরু কাঁদিতেছে। সুকুমার রায়ের ঝালাপালা নাটিকায় বুনিয়াদি ইংরেজি শিক্ষার সরলতম বাক্যাংশটিতে গরুর অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন পণ্ডিতমহাশয়। কল্পনা করাই যায় যে, গো-জ্ঞান লইয়া ভারতবর্ষের সমাজ-রাজনীতিতে এখন যে তোলপাড়, তাহার রকম বুঝিতে পারিলে গরুর মায়াময় চোখেও জল আসিত। অধুনা নেতারা বলিতেছেন, গরু বিষয়ক ‘চেতনা’ বৃদ্ধি পাইলে সর্বলোকে তাহার অস্তিত্ব উপলব্ধ হইবে। তাই ‘গো-বিজ্ঞান পরীক্ষা’র ঘোষণা করিয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ। নেতার পিছনেই জনতা, তাই এক ঘণ্টার অনলাইন পরীক্ষা দিবার জন্য নাম লিখাইয়াছিলেন পাঁচ লক্ষ মানুষ। দেশের ৯০০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষা গ্রহণের নির্দেশ পাঠাইয়াছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এই পোড়া দেশে গরু সম্পর্কিত জ্ঞান যত্রতত্র মেলে না, পুস্তক বা গবেষণাপত্রে তো নহেই, সরকার হইতেই ‘স্টাডি মেটিরিয়াল’-এর জোগান দিবার কথা হইয়াছিল। জানা গিয়াছিল, দীর্ঘ দিন ধরিয়া গবাদি পশু জবাই করিলে তাহাদের মরণ-আর্তনাদের প্রভাব পড়ে ভূস্তরে, সংঘটিত হয় ভূকম্পন, ‘আইনস্টাইন পেন ওয়েভ’-এর দীর্ঘস্থায়ী ফল। ইহা গো-জ্ঞানের একটি উদাহরণমাত্র, এমন মণিমাণিক্য আরও অনেক।
শেষাবধি পরীক্ষা গ্রহণে অস্বীকৃত হইয়াছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রবল ভাবে সমালোচিত হইয়াছে স্টাডি মেটিরিয়াল, অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছাইয়াছে পরীক্ষা। দেশের দুর্ভাগ্য! একবিংশ শতাব্দীতেও এতাদৃশ অবিজ্ঞানকে পাঠ্যসূচির অন্তর্গত করা গেল না। মঙ্গলগ্রহে প্রাণ অন্বেষণ হইল, কিন্তু গরুর দুধে যে তাল তাল সোনা, তাহা মানা হইল না! গোবর দিয়া পারমাণবিক বিকিরণ রোধ সম্ভব নহে— শিক্ষিত সমাজ তর্ক জুড়িল। হায় অবিশ্বাসী, গো-জ্ঞান তো বিজ্ঞান নহে, ইহা একটি স্বতোৎসারিত প্রমাণ-ঊর্ধ্ব বিশ্বাস। বিশ্বাসকে জ্ঞানে স্থান না দিলে, বিজ্ঞানই বা কী করিয়া সৃষ্টি হয়? কালে কালে কি ইহাও তর্কের বিষয় দাঁড়াইবে যে, সূর্যগ্রহণের কালে গহনা পরিলে বিপদ? কিংবা ডাকিনীবিদ্যার কোনও প্রমাণ বা যুক্তি না থাকিলেও তাহা অব্যর্থ?
গত কয়েক বৎসর ধরিয়া বিজেপি সরকারের কল্যাণে ধারাবাহিক ভাবে গো-জ্ঞান পরীক্ষার দিকে অগ্রসর হওয়া যাইতেছিল। শিক্ষিত সমাজ স্বভাবত বিরক্ত। তাঁহারা বলিতেছেন, অবিজ্ঞান ও অন্ধবিশ্বাস এমন স্তরে পৌঁছাইয়াছে, যাহা এখন দেশব্যাপী শিক্ষাক্রমে কুসংস্কারকে প্রবেশ করাইতে চাহে। বলিতেছেন, অশিক্ষা ও অজ্ঞান গা-সহা হইয়াছে, অস্বাভাবিকের স্বাভাবিকীকরণ বা ‘নর্ম্যালাইজ়েশন’ ঘটিতেছে। গত ছয় বৎসরে এক দিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাইতেছে, অন্য দিকে মহাভারত-এ ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজ়েশন’ ও স্টেম-সেল’এর উল্লেখ এবং বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে মিসাইলের সন্ধান মিলিতেছে, রাবণের লঙ্কায় চতুর্বিংশ প্রকারের বিমান ও বিমানবন্দরের অস্তিত্ব পাওয়া যাইতেছে। ১৯৫৬ সালে হিজলি বন্দি শিবিরের স্থলে আইআইটি খড়্গপুর প্রতিষ্ঠিত হইবার পর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলিয়াছিলেন যে, এই পথেই দেশের ভবিষ্যৎ। কামধেনু আয়োগ সেই ‘ভবিষ্যৎ’ নির্মাণ করিতেছে— শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানজীবীরা সে কথা না বুঝিলে তাঁহারা দেশদ্রোহী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy