ইংরেজ সাহেবরা না থাকলে পয়লা বৈশাখের উৎসবও থাকত না। প্রতীকী ছবি।
পর্তুগিজরা না এলে বাঙালির পাতে আলু থাকত না, পশ্চিম এশিয়ার সুফি সাধকরা না এলে প্রবল গ্রীষ্মে হাটে মাঠে জলসেচ ব্যবস্থা তৈরি হত না, আর ইংরেজ সাহেবরা না থাকলে পয়লা বৈশাখের উৎসবও থাকত না। বাঙালি গত শতক অবধি ক্ষুদ্র আত্মম্ভরিতায় ভোগেনি, ‘আমরা ছাড়া সবই তুশ্চু’ জাতীয় মনোবিকলনের শিকার হয়নি। এই যে নতুন বাংলা সন ১৪৩০ শুরু হল, এই ‘সন’ শব্দটাও হয়তো তিব্বতিরা না এলে আমাদের ভাষায় ঢুকত না। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় যখন হানাহানির মাৎস্যন্যায়, তিব্বতরাজ স্রোং সন গাম্পো উত্তর বাংলার বেশ কিছু জায়গা দখল করে নেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার জানিয়েছিলেন, ওই তিব্বতি নৃপতির নাম থেকেই বাংলায় সন শব্দের প্রচলন। এখনকার দিন হলে, এই তত্ত্বের জন্যই হয়তো তাঁকে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু জাতীয়তাবাদ, হিন্দুয়ানি ইত্যাদির মাপকাঠিতে বাঙালির নববর্ষ সন্ধান করা মানে মগ হাতে সমুদ্রের জল মাপা। নববর্ষ সন্ধানে জনা কয়েক পণ্ডিতম্মন্য আজকাল কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক অবধি পৌঁছে গিয়েছেন। কিন্তু যে বাংলায় রক্তমৃত্তিকা, পাহাড়পুর ইত্যাদি হরেক বৌদ্ধবিহার ছিল, জনসমাজে মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম আছড়ে পড়ছিল, সেখানে শশাঙ্কের মতো বৌদ্ধবিরোধী রাজা, যিনি বুদ্ধগয়ার বিহার ও বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করেছিলেন, তাঁর তৈরি ক্যালেন্ডার আমজনতা বছরের পর বছর মেনে নিল? বাংলার মন্দিরগাত্রে বর্ষশেষের চড়ক, গাজন থাকলেও নেই নববর্ষের উৎসব-প্রতীক। বস্তুত, হুতোম থেকে টেকচাঁদ ঠাকুর সকলে চৈত্রসংক্রান্তির দিনটিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। হুতোম তো সাফ জানান, “ইংরেজরা নিউ ইয়ারে বড় আমোদ করেন।… বাঙ্গালিরা সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দেন। কেবল কলসি উচ্ছুগগু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।”
খাতাওয়ালারা অবশ্য গত কালের পুণ্যপ্রভাতেও কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, ঠনঠনেতে ভিড় জমিয়েছিলেন। শুধু শহর কলকাতায় গ্রামীণ বাঙালির গোসেবা কালীপ্রসন্নের নজরে পড়েনি, পড়ার কথা ছিলও না। বাংলা নববর্ষের দিন গ্রামের প্রত্যেক গেরস্তবাড়িতে ‘ভগবতী যাত্রা’ হত। রেকাবিতে ভিজে আতপ চাল, কয়েকটা বাতাসার নৈবেদ্য, তুলসীপাতা, চন্দন নিয়ে গোয়ালঘরে নিয়ে যাওয়া হত, গরুকে পুজো করে তার দুধে পায়েস তৈরি হত। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীচিত্র বইয়ে নদিয়ার মেহেরপুর গ্রামে এই ভগবতী যাত্রার বর্ণনায় চমৎকার একটি বিষয় আছে। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন, এই দিন গ্রামের দোকানগুলিতে নতুন হালখাতা হলেও মারোয়াড়িরা তার আগে রামনবমীতে নতুন খাতা বানায়। এখন বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সকলে নতুন বছরে খাতা খোলে, রামনবমীতে অস্ত্র হাতে মিছিল করে। ওই ভগবতী যাত্রার আগে-পরে কোনও মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারা হত না, তাঁর ভাঁড়ারঘরে উঁকি দেওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবত না। এখানেই বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য।
গ্রামাঞ্চলে ওই ভগবতী যাত্রার দিনই দৈবজ্ঞ আচার্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে জানাতেন— এ বার তোমার শত্রুস্থানে শনি। অসুখবিসুখ নিবারণে মাঝে মাঝে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করতে হবে, এখন জীবন অনেক বেশি সতেজ ও স্বাস্থ্যে ভরা। এ বারের পঞ্জিকায় এক জ্যোতিষী জানাচ্ছেন, তিনি কালা জাদু ও জিন দ্বারা বশীকরণ, মিশরীয় ক্রিস্টাল তন্ত্রে ভাড়াটে উচ্ছেদ ও জমিসমস্যার প্রতিকার করেন। একুশ শতকেও দেশি, বিদেশি হরেক সংস্কৃতির আত্তীকরণ না ঘটালে বাঙালির পঞ্জিকা, নববর্ষ কিছুই থাকে না। নববর্ষের প্রথম পূজারি তো কবিয়াল ঈশ্বর গুপ্ত! পয়লা জানুয়ারি কলকাতায় সাহেবদের বর্ষবরণ দেখে তিনি মুগ্ধ, “নববর্ষ মহাহর্ষ, ইংরাজটোলায়। দেখে আসি, ওরে মন, আয় আয়।” সাহেবদের এই অনুষ্ঠান দেখেই তো ঔপনিবেশিক বাঙালির আনন্দময় পয়লা বৈশাখ। সে দিন অনেকে খাঁটি বাঙালি খাবার খোঁজেন। কিন্তু খেয়াল রাখেন না, মঙ্গলকাব্যে বিজাতীয় আলুর ব্যবহার নেই, ‘রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ/ মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ।’ এখন প্রসাদী খিচুড়িতেও আলু, বাঁধাকপি। লঙ্কাও পর্তুগিজদের উপহার। পারশে, পাবদা, ইলিশ রান্নার সর্ষে এসেছে মিশর থেকে। লবঙ্গ ইন্দোনেশিয়া, ধনে ইউরোপের অবদান। অশন-বসন-উৎসবের সংস্কৃতিতে পয়লা বৈশাখ কোনও দিনই ক্ষুদ্র, কূপমণ্ডূক বাঙালির উৎসব নয়। তা বৃহৎ বাঙালির বহু সংস্কৃতির বহতা ধারায় পুষ্ট। সেখানেই প্রকৃত মঙ্গলযাত্রা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy