Advertisement
E-Paper

ঝুরঝুরে বাড়ি

বাড়ির আয়ু হিসাবে তো ৮০-৮৫ বছর ধার্য করা হয়, তবে এই বাড়িগুলো ৩০-৩৫ বছর বয়সেই থুত্থুড়ে হচ্ছে কী ভাবে? নিশ্চয়ই নির্মাণ-কৌশলে অগাধ ত্রুটি ছিল।

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৬
Share
Save

ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্‌লায় ভিজে, একা বুড়ি কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে।” সুকুমার রায়ের ‘বুড়ির বাড়ি’ মেলে একুশ শতকেরই পশ্চিমবঙ্গে। সেখানেও ভারী বৃষ্টিতে ছাদ দিয়ে জল নামে, কার্নিস ভেঙে নীচের গাড়ির কাচ ভাঙে, বাড়ির গায়ে গাছ ওঠে, শিকড়ের চাপে দেওয়ালে ফাটল ধরে। কিন্তু বুড়ির বাড়ি ছিল তার নিজের, তাই সে সাধ্যমতো ঠেকা দেওয়ার চেষ্টা করত। এ কালের ‘বুড়ির বাড়ি’ হল সেই সব সরকারি আবাসন, যেখানে স্বল্প ভাড়ায় ফ্ল্যাট নিয়ে বা চাকরিসূত্রে থাকেন বহু মানুষ। ইমারতগুলি মেরামতের দায়িত্ব তাঁদের নয়, আবাসন দফতরেরই। কিন্তু তাদের ঘন ঘন এত্তেলা দেওয়া সত্ত্বেও সংস্কারের উদ্যোগ নেই, উল্টে দফতরই একটি আবাসনের সাতটি ব্লক-এ ‘বিপজ্জনক’ নোটিস ঝুলিয়েছে। জানিয়েছে, নোটিসের এক্তিয়ার তাদের আছে। তবে, মেরামতির টাকা এই মুহূর্তে নেই। তাই সংস্কার আটকে!

আরও বিস্ময় জাগে যে, বাড়ির আয়ু হিসাবে তো ৮০-৮৫ বছর ধার্য করা হয়, তবে এই বাড়িগুলো ৩০-৩৫ বছর বয়সেই থুত্থুড়ে হচ্ছে কী ভাবে? নিশ্চয়ই নির্মাণ-কৌশলে অগাধ ত্রুটি ছিল। তবে, এই কারণ দেখেই সরকার সব দোষ বাম আমলের ঘাড়ে দিলেই প্রশ্ন উঠবে, তা বলে কি বাড়িগুলির তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায় বর্তমান প্রশাসনের নয়? তাদের ঔদাসীন্যে সন্দেহ, আবাসনগুলির জীর্ণতা কি কাঙ্ক্ষিত, যাতে পরে ফাঁকা প্লট বেসরকারিকরণে সুবিধা হয়? কোনও বিশেষ সরকার-চালিত শাসনতন্ত্রের নয়, আসলে দোষ এখানে পশ্চিমবঙ্গের কর্মসংস্কৃতির, আলস্য ও দায়িত্ববোধের অভাবই যার বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই এখানে আশু প্রয়োজনীয় ফাইল বাঁধা হয় দীর্ঘসূত্রতার ফাঁসে। আর উৎসব ছাড়া কাজের নাম করলেই টাকার দৈন্যের ওজর হাজির। গাফিলতির এই ঘুঘুর বাসাতেই জন্মায় দুর্নীতি। যার বড় প্রমাণ শহর জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি নির্মাণ এবং প্রতিনিয়ত তাদের বসে যাওয়ার, হেলে যাওয়ার খবরাখবর।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রতিটি মানুষের সংবিধানসিদ্ধ মৌলিক অধিকার। সেই প্রয়োজন মেটানো, মাথার ছাদ যাতে সুরক্ষিত থাকে, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতির কারণ না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখাও সরকারের কর্তব্য। সরকারি আবাসনের দেখাশোনার পাশাপাশি বেসরকারি নির্মাণের স্বচ্ছতার প্রতি নজরদারিতেও প্রশাসন দায়বদ্ধ। ভূমি সমীক্ষা, নকশা পরীক্ষা, নির্মাণের সময় দক্ষ প্রকৌশলী নিযুক্ত হয়েছে নাকি টাকা বাঁচাতে অদক্ষ কর্মীকে পরিকল্পনার ভার দেওয়া হয়েছে, মালমশলার দিকে কড়া নজর— প্রোমোটার, বিল্ডাররা সব ধাপ যথাযথ ভাবে মানছে কি না, দেখেই নতুন নির্মাণের আবেদন গ্রাহ্য করতে হবে। বাড়ি তৈরির সময় ও পরেও নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি। নচেৎ, নরম মাটির শহরে বিপদপ্রহর বাড়তেই থাকবে। পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তোলায় রাশ টানা, গঙ্গা নিকটস্থ বহুতলের ক্ষেত্রে ভূ-প্রযুক্তিবিদের পরামর্শ ও সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলির পালন জীবনদায়ী। আইনি কাগজপত্র মিলিয়ে সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের নীতিগুলি জানা, নির্মাণ-প্রযুক্তিবিদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে বাসিন্দাদেরও সচেতন হতে হবে। সরকার বা উপভোক্তা দুই পক্ষেরই সামান্যতম অনবধানে কী বিপদ ঘটে যায়, তার সাক্ষী বর্তমান শাসক জমানার গার্ডেনরিচের বহুতল বিপর্যয় ও বাম আমলের ‘শিবালিক অ্যাপার্টমেন্ট’-এর ভয়াবহ স্মৃতি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Constructions Promoter Corruption

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}