ভারতে দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রোপচারে প্রসবকে ‘স্বাভাবিক’ বলে তুলে ধরা হচ্ছে বিত্তবানদের কাছে। প্রতীকী ছবি।
ভারতে প্রসবের জন্য অস্ত্রোপচারের (সিজ়ারিয়ান সেকশন) হার অত্যধিক, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্টে তা ফের স্পষ্ট হল। উত্তর ভারতের গোবলয়ের রাজ্যগুলির তুলনায় দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে, এবং সরকারি হাসপাতালের চাইতে বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের হার অনেক বেশি। অর্থাৎ, প্রসূতির পরিবারের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে অস্ত্রোপচারের একটি সুনির্দিষ্ট সংযোগ রয়েছে। নিরাপদ প্রসবের প্রয়োজনের চেয়ে পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে অস্ত্রোপচারের সংযোগ বেশি ঘনিষ্ঠ, এই তথ্য ভারতীয় চিকিৎসাব্যবস্থার প্রকৃত চেহারাটি স্পষ্ট করে। এক দিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার চাহিদা উপেক্ষিত হচ্ছে, অন্য দিকে জোগানের তাগিদে তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম চাহিদা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দশ থেকে পনেরো শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হওয়ার কথা। কোনও কোনও রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালে চিত্রটি একেবারে বিপরীত। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রায় চুরাশি শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। এমন একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছে যে, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অস্ত্রোপচারে ঝুঁকি কম, মা ও শিশুর পক্ষে তা বেশি নিরাপদ। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল— স্বাভাবিক প্রসবের যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রসূতি দ্রুত সেরে ওঠেন, দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার সম্ভাবনা কম থাকে। কোনও উন্নত দেশে অস্ত্রোপচারের বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে তা করা হয় না। ভারতে দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রোপচারে প্রসবকে ‘স্বাভাবিক’ বলে তুলে ধরা হচ্ছে বিত্তবানদের কাছে।
এই ‘স্বাভাবিকীকরণ’-এর প্রক্রিয়ার শরিক হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলিও। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের নানা রাজ্যে সরকারি হাসপাতালেও অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার প্রত্যাশিত হারের তুলনায় অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অর্থলাভের সম্ভাবনা না থাকলেও, সময় বাঁচানোর তাগিদ থাকে। যাঁরা নৈতিক আচরণে আগ্রহী, তাঁদের কাছেও স্বাভাবিক প্রসবের নির্বাচন ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে হতে পারে, কারণ প্রসূতির অবস্থার নিয়মিত নজরদারির দায়িত্ব চিকিৎসকের উপরেই বর্তায়। যথেষ্ট প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকলে তাঁরা ভরসা পান না। দায় রয়েছে স্বাস্থ্য বিমার শর্তেরও। পশ্চিমবঙ্গে যেমন ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বিমায় সিজ়ারিয়ান সেকশন কেবল সরকারি হাসপাতালে করার নির্দেশ রয়েছে, অস্ত্রোপচার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, সে প্রশ্ন তোলার রীতি নেই। বেসরকারি বিমায় তো কখনওই সে প্রশ্ন ওঠেনি। ফলে সব দিক থেকেই অস্ত্রোপচারে প্রসব ‘লাভজনক’ মনে হতে থাকে চিকিৎসাপ্রার্থী এবং চিকিৎসকের কাছে।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার দায় অনেকটাই বর্তায় চিকিৎসক সমাজের উপর, যার প্রতিনিধি চিকিৎসক সংগঠনগুলি। চিকিৎসকদের স্বার্থরক্ষাই তাদের একমাত্র কাজ হতে পারে না, চিকিৎসাব্যবস্থায় পেশাদারিত্ব ও ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ স্থাপন করাটাও সংগঠনগুলির কর্তব্য। দায় সরকারেরও— ভারতে সরকারি হাসপাতালগুলিই বরাবর চিকিৎসার আদর্শ মান বেঁধে দিয়েছে। সেখানে চিকিৎসাপ্রার্থীর নিরাপত্তাই প্রথম ও শেষ কথা। চিকিৎসকের সুবিধে প্রধান বিবেচ্য নয়। সুলভ ওযথাযথ চিকিৎসার উপযোগী পদ্ধতিতে ফিরতে হবে সরকার ও চিকিৎসক সমাজকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy