পরীক্ষার নম্বর যেমন, পাঁচ জনের প্রশংসাও তেমন তাদের কাজ দ্বিস্তরীয়। প্রতীকী ছবি।
পরীক্ষার নম্বর যেমন, পাঁচ জনের প্রশংসাও তেমন— তাদের কাজ দ্বিস্তরীয়। প্রথমত, যিনি পরীক্ষা দিচ্ছেন, বা যাঁর কাজ প্রশংসিত হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারবেন, ঠিক কতখানি পারলেন। দ্বিতীয়ত, সেই নম্বর বা প্রশংসা যদি প্রকাশ্যে আসে, তা হলে বৃহত্তর সমাজের পক্ষেও বোঝা সম্ভব হয়, সেই নির্দিষ্ট বিষয়টিতে সমাজের সামগ্রিক গুণগত মানের ছবিটা ঠিক কী রকম। বস্তুত, যে কোনও সূচকভিত্তিক র্যাঙ্কিং বা ক্রমাঙ্কন এই কাজটাই করে থাকে। নম্বরের সঙ্গে প্রশংসার একটা চরিত্রগত প্রভেদ আছে, তা ঠিক— নম্বর দেন এক জন, বা বড় জোর জনাকয়েক বিশেষজ্ঞ; কোনও সাহিত্য বা শিল্পকর্মের তারিফ করার অধিকারী সবাই। কিন্তু, পরিসংখ্যানতত্ত্বের ‘ল অব লার্জ নাম্বারস’-এর ধারণাটির সাহায্য নিয়ে বলা চলে, যদি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ কোনও কাজের মূল্যায়ন করেন, তবে তা সমগ্র জনগোষ্ঠীর গড় মূল্যায়নের কাছাকাছিই থাকবে। অতএব, নম্বর হোক বা সম্মিলিত প্রশংসা, তার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিহিত থাকে। কিন্তু, কোনও কারণে যদি সেই তারিফ সহজলভ্য হয়ে দাঁড়ায়? সমাজমাধ্যমে অধুনা তেমন ঘটনা আকছার ঘটে। কেউ তাঁর দেওয়ালে নিজের লেখা কবিতা, গাওয়া গান অথবা অন্য যা-ই শেয়ার করেন, বহু মানুষ সেখানে ‘লাইক’ দিয়ে যান, লেখেন প্রশস্তিসূচক মন্তব্য। যে কোনও পরিসরের মতোই এ ক্ষেত্রেও কিছু সৃষ্টিকর্মের গুণমান সত্যই উৎকৃষ্ট, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা নয়। প্রশ্ন হল, সেই সাধারণ মানের কবিতা, ছবি বা গানেও যদি উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্য জমা হতে থাকে?
সে ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটবে, তাকে বলা যেতে পারে তারিফ-স্ফীতি। তার চরিত্র মুদ্রাস্ফীতির মতোই। বাজারে টাকার পরিমাণ (অতিরিক্ত) বাড়লে— এবং প্রকৃত পণ্যের জোগান সেই তুলনায় সীমিত থাকলে— যেমন প্রতি একক টাকার ক্রয়ক্ষমতা বা দাম কমে, তারিফের ক্ষেত্রেও কার্যত তা-ই ঘটবে: এক একক প্রশংসার দাম আগের চেয়ে কম হবে। আগে শুধু ‘ভাল হয়েছে’ বললে যতখানি প্রশংসা বোঝাত, তারিফ-স্ফীতি ঘটলে ততখানি প্রশংসা করার জন্য হয়তো বলতে হবে, ‘কী অকল্পনীয় হয়েছে, তা বলে বোঝানোর ভাষা নেই’। কিন্তু, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তারিফ-স্ফীতির একটা প্রভেদও আছে। প্রথম ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে বোঝা সম্ভব যে টাকার দাম কতখানি কমল— আগে এক কেজি চাল কিনতে চল্লিশ টাকা লাগত, এখন লাগে পঞ্চাশ টাকা, অতএব আগের তুলনায় এখন এক টাকায় পাঁচ গ্রাম চাল কম মিলবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংখ্যার সাহায্য মেলে না— নতুন তারিফকে পুরনো তারিফের মাপকাঠিতে ফেলে তুলনা করার উপায় নেই। অতএব, তারিফের মধ্যে যে তথ্য নিহিত থাকার কথা, তা ক্রমশ ক্ষয়ে যায়। তারিফ ক্রমশ ‘অর্থহীন’ হয়ে ওঠে। যিনি প্রশংসা পাচ্ছেন, এতে তাঁর ক্ষতি হয় বটে, কিন্তু সমাজের ক্ষতি তুলনায় অনেক বেশি। শিল্প বা সাহিত্যের মতো ক্ষেত্রে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুণমানের বণ্টন ঠিক কেমন, তা বোঝার উপায় থাকে না।
এমন অবস্থা তৈরি হয় কেন? তার উত্তর স্বভাবতই বহুবিধ। একটি উত্তর: প্রতি একক তারিফের প্রকৃত সামাজিক গুরুত্ব যতখানি, সেই তুলনায় তার জন্য ব্যয়ের মাত্রা নিতান্তই কম। মুখে বাহবা জানাতে, এবং তার চেয়েও বেশি করে, সমাজমাধ্যমে ‘লাইক’ ঠুকতে কার্যত কোনও পরিশ্রম নেই, অর্থ বা ভিন্নতর কোনও ব্যয়ও নেই। ফলে, তা দেদার বিলিয়ে যাওয়া চলে— বিনয় মজুমদারের কবিতার যে তারিফ প্রাপ্য, এথেনিয়াম ইনস্টিটিউটের বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতাতেও সেই তারিফ করা যায়। ধরা যাক, যদি ‘লাইক’ দেওয়ার উপর কোনও ব্যয় আরোপ করা যেত? ‘ব্যয়’ নানা ধরনের হতে পারে। একটি লাইক দিতে হলে এক টাকা লাগবে, এটা এক ধরনের ব্যয়। কোনও পোস্টে কেন লাইক দেওয়া হল, তার অডিট হতে পারে, এবং সেখানে যথাযথ জবাব দিতে না পারলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করে দেওয়া হবে, এটা আর এক ধরনের ব্যয়। অথবা, প্রত্যেকের হাতে সীমিতসংখ্যক লাইক বরাদ্দ করা হল, ফুরিয়ে গেলে আর দেওয়ার উপায় থাকবে না— এটাও ব্যয়ের একটা রূপ। আরও অনেক উপায়ই থাকতে পারে। যে উপায়েই হোক, তারিফ-স্ফীতিতে লাগাম পরাতে পারলে লাইক দেওয়ার আগে মানুষ এখনকার তুলনায় বেশি ভাববে। তাতে ‘লাইক’ বস্তুটির গুরুত্ব থাকবে, কোনও জিনিসের গুণমান জ্ঞাপনের ক্ষমতাটিও তার বজায় থাকবে। উন্নতি ঘটবে সমাজমাধ্যমের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy