ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বকালের সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত শব্দটি কী, তাহা সন্ধান করিলে ‘পুঁজি’ সম্ভবত অন্য সকল শব্দকে দশ গোল দিবে। নেহরু-যুগের এই একটি অভ্যাস দেশের রাজনীতি ছাড়িতে পারে নাই। স্বয়ং জওহরলাল নেহরু একাধিক বার বলিয়াছিলেন, সম্পদ সৃষ্টি হইলে তবে তাহার সুষম বণ্টনের প্রশ্নটি উঠে— কিন্তু, বলিয়াও শেষ অবধি বেসরকারি পুঁজির প্রতি অবিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিতে পারেন নাই। বেসরকারি উদ্যোগে সম্পদ সৃষ্টি না হইলে যে রাষ্ট্রের পক্ষেও তাহার কল্যাণ কর্মসূচি চালাইয়া যাওয়া কঠিন, এই কথাটি ভারতীয় রাজনীতি বুঝিয়াও বুঝে নাই। ফলে, উদ্যোগপতিদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে সফল হইবার সহজতম পন্থা, এখনও। ফলে, সংসদে দাঁড়াইয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ঘোষণা করিলেন যে, ভোটে জেতার জন্য সম্পদ নির্মাতাদের উপর কলঙ্ক লেপন আর চলিবে না, তখন আশাবাদী হইতে হয়। এই বাজেটেই স্পষ্ট স্বরে বেসরকারিকরণের কথা বলিয়াছেন অর্থমন্ত্রী— জানাইয়াছেন, সরকার অনন্তকাল ধরিয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালাইয়া যাইতে পারে না। ভারত কি আশা করিতে পারে যে, খিড়কির দরজা দিয়া লুকাইয়া সংস্কারের বাধ্যবাধকতা এই বার ফুরাইবে? এই বার ভারতে পুঁজি তাহার প্রাপ্য সম্মান পাইবে? রাজনীতি স্বীকার করিবে যে, রাষ্ট্রকে নিজের কাজটি ঠিক ভাবে করিতে দিতে হইলে পুঁজিকেও সম্মান ও স্বাধীনতা দেওয়াই বিধেয়?
তবে, পুঁজির গুরুত্বকে শুধু রাজনৈতিক স্তরে স্বীকার করিলেই যথেষ্ট হইবে না। সাধারণ মানুষের মনে পুঁজি সম্বন্ধে যে বিরূপতা এবং ভীতি, তাহা দূর করিতে হইবে। তাহার একটিমাত্র পথ— পুঁজির উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারির নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে জনমানসে ইতিবাচক ধারণা গড়িয়া তোলা। সেই কাজটি কথায় হইবার নহে, তাহার জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাহুল গাঁধী যখন সংসদে দাঁড়াইয়া ‘হম দো, হমারা দো’ বলিয়া বক্রোক্তি করেন, তাহা জনগণের মনের তার স্পর্শ করিতে পারে একটিই কারণে— বিশেষত বর্তমান জমানায় দেশবাসী ধনতন্ত্র আর সাঙাততন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য খুঁজিয়া পান না। রাহুলের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ শানাইতে অর্থমন্ত্রী ‘জামাতা’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে রাহুলের সমালোচনার সদুত্তর মিলে নাই। পূর্বতন জমানায় সাঙাততন্ত্র ছিল বলিয়া বর্তমান জমানায় তাহা বৈধ হইয়া যায় না। বিশেষত, যে সরকার অতি ন্যায্য ভাবেই পুঁজির সম্মানের কথা বলিতেছে, সেই সরকার এই ঢাল ব্যবহার করিতে পারে না। তাহাকে এই সাঙাততন্ত্রের সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে।
অতএব, পুঁজিকে যদি সম্মানের সঙ্গে কাজ করিতে দিতে হয়, যদি প্রকৃত অর্থে ধনতন্ত্রের সাধনা করিতে হয়, তবে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব স্বীকার করিতেই হইবে। ভারতে নজরদারি সংস্থার অভাব নাই— বস্তুত, কেহ বলিতে পারেন, দেশে তেমন সংস্থার বিপুলতাই উদ্বেগের কারণ— প্রয়োজন সেই সংস্থাগুলির দাঁত-নখ। তাহাদের প্রকৃত স্বাতন্ত্র্য। রাজনৈতিক নেতারা যাহাতে খিড়কির দরজা দিয়া সেই সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ না করিতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। বেনিয়ম দেখিলে যেন রাজনৈতিক নৈকট্য বিবেচনা না করিয়াই শাস্তিবিধানের সাহস নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির থাকে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, গত কয়েক বৎসরে ভারতে এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হইয়াছে— অন্তত জনমানসে সেই ধারণা প্রবল। খাঁচার তোতা যে প্রভুর শিখানো বুলি বই আর কিছু আওড়াইতে পারে, তাহা বিশ্বাস করা মানুষের পক্ষে মুশকিল। ধনতন্ত্রের সাধনা করিতে চাহিলে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি বিশ্বাস ফিরাইয়া আনা প্রয়োজন। তাহার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি, তাহা সরকার দেখাইতে পারিবে কি না, তাহাই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy