সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেরালা স্টোরি নামক চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। ফাইল ছবি।
এক দিকে গণতন্ত্রের বুলি, অন্য দিকে নিষেধাজ্ঞার ঝুলি: এই দ্বিচারিতা ভারতীয় রাজনীতি মহলের মজ্জাগত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে রাজ্য সরকার, সকলেই এই দ্বিচারিতার পোষক। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেরালা স্টোরি নামক চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। প্রশ্ন হল, এমন কী ঘটল যাতে গণতান্ত্রিক পরিসর বন্ধ করার এই অন্যায় রাস্তাটি নিতে হল? সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গকে যে নোটিসটি দিয়েছে শুক্রবার, নেতারা তার উত্তরে কী বলতে পারেন, অনুমান করা কঠিন নয়। চলচ্চিত্রটি ধর্মীয় রক্ষণশীলতার অন্যায় এবং ‘কাল্পনিক’ কাহিনি প্রচার করতে উদ্যত, যার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কদর্য প্রচার স্পষ্ট, যাতে দেশের সামাজিক স্থিতি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা সমূহ। এই উদ্বেগ অনুমান করেই সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের আগাম যুক্তি, দেশের অন্যত্র যদি এই চলচ্চিত্র দেখানো যায়, তা হলে এই রাজ্যেই বা যাবে না কেন। গণতান্ত্রিক দেশ যে দিন তার সংবিধানে বাক্স্বাধীনতার নীতিতে স্বাক্ষর করেছে, সে দিন থেকেই তো এই ‘বিপন্নতা’র দুয়ার সে খুলে রেখেছে। বাক্স্বাধীনতা বাস্তবিক একটি বিপজ্জনক দরজা: তার মাধ্যমে বহু বিপদ প্রকাশ্যে কিংবা প্রচ্ছন্নে সমাজে সেঁধিয়ে যেতে পারে। বিপদ আটকানোর পথ— দরজাটি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া নয়। বরং বিপদ যদি ঢোকে, তার মোকাবিলার জন্য সমাজকে যথেষ্ট সবল ও শক্তিমান করে তোলা। সমাজ যাতে তার নিজের শক্তিতেই বিপদকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে, তার জন্য পাল্টা মতের প্রচার করা, ভুলকে ‘ভুল’ বলে নির্দেশ করা। ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রটিতে তথ্যগত ভাবে অনেক ভ্রান্তি ও বিকারের কথা— সে সব বিশদ ভাবে গণমাধ্যমে এবং জনপরিসরে আলোচনা করা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাকে আটকে দেওয়া হলে বিপন্নতাটিকেই আরও অনেক গুণ বাড়ানো হয়। কেননা তখন আর উল্টো দিকের অসহিষ্ণুতা-প্রসূত নিষেধাজ্ঞাকে প্রশ্ন করার জায়গা থাকে না, গণতান্ত্রিকতার পরিসরটি নিজেরাই নষ্ট করে ফেলার পর অন্যকে আর তা নষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত করা যায় না।
সমস্যা আরও। যদি একটি চলচ্চিত্র সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভ্রান্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে কাহিনি ফাঁদে, তাতে কত মানুষ শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত হতে পারেন? সংখ্যা যা-ই হোক, সাধারণ বুদ্ধি বলে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ এই কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট হবেন কেবল নিষেধাজ্ঞাটি শুনেই। মনুষ্যমানসপ্রকৃতিই এই প্রকার। নগরে-মফস্সলে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটি যখন আদৌ তেমন জনপ্রিয় হয়নি, সেই সময় নিষেধাজ্ঞার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বহুসংখ্যক মানুষ কৌতূহল-বশবর্তী হয়ে পড়লেন। সিনেমাটিকে এক রকমের উল্টো সাফল্যে মণ্ডিত করা ছাড়া এই নিষেধ-নির্দেশের লাভটি কী দাঁড়াল, বোঝা মুশকিল।
অবশ্যই, কেবল বর্তমান সরকারই এই দোষে দুষ্ট নয়। যে বিরোধীরা আজ সরবে সবিস্তারে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাঁদেরই একাংশ কিন্তু তসলিমা নাসরিনের দ্বিখণ্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করেছিলেন এই রাজ্যে, লেখককে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এই ঘটনাতে তার মধ্যেও সে দিন গণতন্ত্রের নিখাদ পরাজয় ছিল, আজকের ঘটনার মধ্যেও আছে। আজকের বিরোধী পক্ষ যদি বর্তমান সরকারের এই সিদ্ধান্তের মধ্যে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ দেখতে পান, সেই তোষণ উল্লিখিত ঘটনাটির মধ্যেও পুরো মাত্রায় ছিল। বরং আজ যদি সরকারি উদ্বেগ হয়ে থাকে সংখ্যালঘু সাধারণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে, তবে সে দিনের তোষণ কিন্তু ধাবিত হয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থী অংশটিকে ‘তুষ্ট’ করার দিকে। দুর্ভাগ্য যে, চলচ্চিত্রে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে নির্লজ্জ আক্রমণের সঙ্গে চলচ্চিত্রবিরোধিতার প্রকরণ, দুই-ই ভারতীয় গণতন্ত্রের মাথা নিচু করছে পরাজয়ের গভীর লজ্জায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy