সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল চিত্র।
মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কের মতো ‘পাবলিক অফিস’ অর্থাৎ জনস্বার্থের সংশ্লিষ্ট কোনও পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁদের মুখের ভাষা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধি স্থির করা কি আদালতের কাজ? সেই দায়িত্ব কি আইনসভার নয়? উত্তরপ্রদেশের এক ভূতপূর্ব মন্ত্রীর একটি কটু মন্তব্যের প্রসঙ্গে দায়ের-করা এক মামলার সূত্রে সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারি আইনজীবীদের বক্তব্য: এ ক্ষেত্রে আদালত অতীতে যে সামগ্রিক নির্দেশিকা জারি করেছে সেটাই যথেষ্ট, জনপ্রতিনিধিদের আচরণবিধি সংশোধনের বাকি কাজ আইনসভার হাতেই ছেড়ে দেওয়া সঙ্গত। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা এই যুক্তির সারবত্তা অস্বীকার করেননি, কিন্তু তাঁদের বক্তব্য: জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রীরা কী বলবেন, কী বলবেন না, সে বিষয়ে একটি অলিখিত বিধান বরাবরই প্রচলিত ছিল, সংবিধানের মূল সুরটির অনুসারী সেই রীতি মোটের উপর মেনে চলা হত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীরা যদি সেই রীতির তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ কটূক্তি করে চলেন, যার ফলে অপরের মর্যাদায় বা আবেগে আঘাত লাগে, তা হলে প্রতিকারের উপায় কী? অর্থাৎ, অলিখিত বিধান কাজ না করলে কি কঠোর এবং নির্দিষ্ট লিখিত নিয়ম জারি করেই বাক্সংযম প্রতিষ্ঠা করতে হবে?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। আইনসভা এবং বিচারবিভাগের দায়ভাগ নির্ধারণের প্রশ্ন বিভিন্ন উপলক্ষে বারংবার বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে। এ ক্ষেত্রে উপলক্ষটি জনপ্রতিনিধিদের আচরণবিধির সঙ্গে জড়িত। লক্ষণীয়, আইনসভার অভ্যন্তরে তাঁদের আচার-আচরণ নিয়েও ক্রমাগত প্রশ্ন ওঠে। তার মীমাংসার এক্তিয়ার প্রধানত সভার অধ্যক্ষের হাতেই ন্যস্ত। কিন্তু কালক্রমে সেই মীমাংসার নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সংসদে ও বিধানসভায় অবাঞ্ছিত আচরণের প্রবণতা। রাজনীতির পরিসরে অবাঞ্ছিত উক্তির নজির বরাবরই আছে, কিন্তু কুকথার প্লাবন এখন যে ভাবে অন্তহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাকে অভূতপূর্ব বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। গত কয়েক বছরে দেশ জুড়ে, এবং এই রাজ্য জুড়েও, তার অজস্র দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে, যার প্রকোপে নাগরিকদের চোখ ও কান ক্রমে এই কদর্যতাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। রাজনীতির সার্বিক অবনমন এই কদর্যতার সঙ্গে ওতপ্রোত। আদর্শ বা নীতিবোধের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল, উন্নয়ন বা জনকল্যাণের কর্মসূচি ও প্রকল্পের আলোচনাও ক্রমশ রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে, সমস্ত আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগত কুৎসা ও প্রতি-কুৎসার উপর। অ-সভ্যতাই যেন এখন ভারতীয় রাজনীতির অন্য নাম।
এই অ-সভ্যতার কঠোর শাস্তি না হলে রোগ সারানোর কিছুমাত্র ভরসা আছে কি? আরও বড় কথা— সুস্থ, সভ্য আচরণ জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, আধিকারিক ইত্যাদি উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাবানদের প্রাথমিক কর্তব্য, তাতে বিচ্যুতি ঘটলে কঠোর শাস্তিবিধানই কি বিধেয় নয়? সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিরা এই বিষয়ে গভীর ভাবে বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন, ভারতীয় গণতন্ত্র তার অপেক্ষায় থাকবে। নাগরিকরা আশা করবেন, সেই সিদ্ধান্ত রাজনীতিকদের আচরণের যথার্থ সংস্কার করতে পারবে। সে জন্য প্রয়োজনে আদালতকে হয়তো অতিরিক্ত কঠোর ও ‘অ-সহিষ্ণু’ হতে হবে। কোনও ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তি সভ্য সমাজের উপযোগী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে যদি তাঁর কঠোর শাস্তি হয়, বিশেষত তাঁর সক্রিয় রাজনীতির অধিকার অন্তত সাময়িক ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়, তা হলে কাজ হতে পারে। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার প্রসঙ্গে বিচারকদের কথায় ও সিদ্ধান্তে লক্ষণীয় কঠোরতার নিদর্শন মিলেছে, সমাজে কিছু আশার সঞ্চারও ঘটেছে। দুর্নীতি ও দুর্বিনয়, উভয়েই শক্তের ভক্ত, নরমের যম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy