রাজীব গান্ধী। ফাইল চিত্র।
অহিংসা পরম ধর্ম, ক্ষমা মহৎ গুণ— শিখিয়েছে প্রাচ্যদেশীয়, বিশেষত ভারতীয় শাস্ত্র ও নীতিগ্রন্থগুলি, যুগযুগান্ত ধরে। বলেছে এ-ই হল আদর্শ, ব্যক্তি এমনকি সমষ্টির জীবনেও এই দুইয়ের আচরণ ও লালন হওয়া দরকার। ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে যদি বা তা কিছু পরিমাণেও হয়, রাজনীতিতে পুরো উল্টো— হিংসা ও অক্ষমার বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়ে চার পাশে। সে কারণেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাজীব গান্ধী হত্যা মামলার আসামিদের সম্প্রতি মুক্তিলাভের ঘোষণায় আবারও হুলস্থুল পড়েছে। কংগ্রেসের রাগ ও বিক্ষোভ; প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর হত্যার অপরাধে জড়িত অভিযুক্তরাই যদি ছাড়া পেয়ে যায় তা হলে সাধারণ মানুষ কী করে সুবিচার পাবেন, এই খেদ ও ক্রোধের প্রকাশের মধ্যে শোনা গেল অন্য সুর: অন্যতম অভিযুক্ত নলিনী শ্রীহরণের মুখে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ। ২০০৮-এ ভেলোর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নলিনীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রিয়ঙ্কা, রাজীব-হত্যার ঘটনায় তখনও তিনি আবেগাপ্লুত। আশ্চর্য, পরের বছরেই তাঁর এক টিভি-সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল ‘ক্ষমা’র প্রসঙ্গ। বলেছিলেন, বাবার মৃত্যুতে স্রেফ হত্যাকারীদের উপরেই নয়, ‘বিশ্বচরাচরের উপর ক্ষিপ্ত’ এক তরুণী থেকে কী করে তিনি হয়ে উঠলেন এক ‘ক্ষমাশীল কন্যা’— রাজীব-হত্যা পরিস্থিতির তিনিই একমাত্র ‘শিকার’ নন, উল্টো দিকের, কারান্তরালের মানুষটিও সমান যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরই মতো সুদীর্ঘ কাল, এই বোধোদয়ে। এই উপলব্ধিতে ‘ভিকটিমহুড’ মুছে যায়, দণ্ডিত ও দণ্ডদাতার প্রতিভূ সমান আঘাতে কাঁদলে যে স্নিগ্ধ উত্তরণ ঘটে তা অতিক্রম করে যায় ক্ষমার সাধারণ স্তরকেও।
মনে করা যেতে পারে সনিয়া গান্ধীর কথাও— বহু বছর আগে, ১৯৯৯ সালেই তিনি নলিনীর হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন করেছিলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনকে অনুরোধ করেছিলেন নলিনীর যেন মৃত্যুদণ্ড না হয়। গ্রেফতারের সময় নলিনী সন্তানসম্ভবা ছিলেন; আসন্নজন্ম নিষ্পাপ শিশুটি যেন কোনও ভাবেই অনাথ না হয়, তা-ই ছিল নলিনীর হয়ে সনিয়ার ক্ষমাভিক্ষার কারণ। ব্যক্তিগত অসহ যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে ক্ষমা করতে পারার নজির চার পাশে তত চোখে পড়ে না— দাঙ্গায় নিহত পুত্র, কিংবা ধর্ষিতা মেয়ের হত্যাকারীর উদ্দেশে ক্ষমাবাক্য উচ্চারণ করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা, এবং রাজনীতি-জগতে এই ধরনের উদাহরণ নিতান্ত বিরল। রাজনীতি ক্ষমতা নিয়ে কারবার, ক্ষমতায় সবই জয়-পরাজয়ের নিক্তিতে বিচার্য, সেখানে হিংসার মোকাবিলা হয় প্রতিহিংসা দিয়ে, অহিংসা বা ক্ষমার আশ্রয়ে নয়। অথচ অভিধান বলছে ‘ক্ষমা’ ও ‘ক্ষমতা’ এক ধাতুতে গড়া, আক্ষরিক অর্থে তো বটেই, প্রসারিত অর্থেও— চোখের বদলে চোখ নিতে পারে যে কেউ, ক্ষমতা মানে ক্ষমা করতে পারারও সামর্থ্য। রাজনীতি যখন স্বতঃসিদ্ধের মতো ক্ষমাকে হীন দুর্বলতা ভেবে নেয়, তখন এই বিরল দৃষ্টান্তগুলি দেখিয়ে দেয় ক্ষমার অমিত শক্তি, সমষ্টির ক্রোধের বিপ্রতীপে তার শান্ত প্রতিমাটি। এ হয়তো মূর্তিমান ব্যতিক্রম, প্রকারান্তরে চিরাচরিতেরই প্রমাণ, তা বলে তাকে অস্বীকার করা যায় না; ক্ষমা করতে না পারাটা শ্লাঘার নয়, সে নিতান্তই ‘অক্ষমতা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy