সমলিঙ্গের দুই নাগরিকের বিবাহ আইনে স্বীকৃত হোক এই মর্মে একগুচ্ছ আবেদন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গত ১৮ এপ্রিল থেকে যে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। ফাইল ছবি।
সমলিঙ্গের দুই নাগরিকের বিবাহ আইনে স্বীকৃত হোক— এই মর্মে একগুচ্ছ আবেদন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গত ১৮ এপ্রিল থেকে যে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে, তার তাৎপর্য অশেষ। প্রশ্ন নিছক বিশেষ বিবাহ আইন সংশোধনের নয়, এই মামলা বিবাহ নামক ব্যবস্থাটি নিয়ে নতুন করে ও গভীর ভাবে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে এবং সেই সূত্রে সমাজ ও ব্যক্তির সম্পর্ক কী হবে সেই বৃহৎ প্রশ্নটিও যাচাইয়ের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় এবং অন্য চার বিচারক বিভিন্ন দিক থেকে এই বিষয়ে যে আলো ফেলেছেন, তা আরও এক বার বুঝিয়ে দেয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ হিসাবে বিচারব্যবস্থা তথা সুপ্রিম কোর্ট কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ময়দানি রাজনীতি দূরস্থান, এই দেশের আইনসভাতেও এই মানের পর্যালোচনা এখন বিরলের মধ্যে বিরলতম বললে অত্যুক্তি হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী য়ুরগেন হাবারমাস ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি’ বা আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্রের বিকাশে বিচারপতিদের মতবিনিময় ও বিশ্লেষণের উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সেই তত্ত্ব নিয়ে অনেক তর্ক, কিন্তু তার গুরুত্ব আজকের ভারতে অত্যন্ত স্পষ্ট।
বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় সরকার এই স্বীকৃতির বিরোধী। তাদের মতে, বিবাহ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের প্রশ্নটি আইনসভার বিচার্য, আদালতের নয়। এবং কেবল জনপ্রতিনিধিমণ্ডলী নয়, জনসাধারণের উপরেও এ-ব্যাপারে শাসকদের ভরসা অপরিসীম। তাঁদের নিশ্চিত প্রত্যয়: ‘এ-সব’ হল শহুরে ‘এলিট’ বা উচ্চকোটির দাবি, আমজনতা বিবাহ বলতে পুরুষ এবং নারীর বিবাহই বোঝেন। প্রসঙ্গত, ভারতের বার কাউন্সিল রায় দিয়েছে, দেশের ৯৯.৯ শতাংশের বেশি মানুষ সমলিঙ্গ-বিবাহকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। কোন সমীক্ষা বা দিব্যজ্ঞান এই পরিসংখ্যানের উৎস, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে দেশের অধিকাংশ নাগরিক যদি সমলিঙ্গের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী হন, বিস্ময়ের হেতু নেই। এই সত্যটি জানেন বলেই শাসকরা নানা ভাবে প্রশ্নটিকে জনতার দরবারে নিয়ে যেতে ব্যগ্র— সব ব্যাপারে যাঁরা রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করতে ব্যস্ত তাঁরা আগ বাড়িয়ে এই বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলির মতামত জানবার প্রস্তাব পেশ করেছেন!
এই বিষয়ে বিচার-বিবেচনার শেষে মহামান্য আদালত যে সিদ্ধান্ত স্থির করবেন, তা অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু বৃহত্তর একটি কথা এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। সামাজিক সংস্কার যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটেই সম্পাদন করতে হত, তবে আজও বহু প্রাচীন কুপ্রথাই বহাল থাকত। প্রশ্ন ভোটের নয়, বনিয়াদি ব্যক্তিস্বাধীনতার। দুনিয়ার যে সব দেশে— এই মুহূর্তে ভারতের ‘নেতৃত্বে’ চালিত জি২০ গোষ্ঠীর অধিকাংশ দেশেও— সমলিঙ্গের বিবাহ স্বীকৃত, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তিই মান্য হয়েছে। লক্ষণীয়, প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাটি নিষ্প্রাণ বা নিশ্চল নয়, বিবর্তনশীল। যাঁরা স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ডারউইনকে নির্বাসন দেন তাঁরা এই মন্তব্যের মর্ম বুঝবেন বলে মনে হয় না। এ-কথা বুঝবার সাধ্যও সম্ভবত তাঁদের নেই যে, ‘সমাজ এখনও প্রস্তুত নয়’ বলে বা অন্য ধরনের কল্পিত সমস্যার অজুহাত দিয়ে যাঁরা সমলিঙ্গ-বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করছেন, তাঁরা ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক শর্তকে লঙ্ঘন করছেন। সমাজ যদি অপ্রস্তুত হয়, প্রস্তুত হয়ে ওঠার দায় তারই। চিরকালই অগ্রবর্তী নাগরিকদের নেতৃত্বে সামাজিক রীতিনীতি পাল্টায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন অভ্যাসে অভ্যস্ত হন। সঙ্ঘ পরিবারের কাছে অগ্রবর্তী চিন্তার প্রত্যাশা করা বাতুলতামাত্র। অন্য অধিকাংশ দলের মতিগতিও আশা জাগায় না। তবে, প্রশ্নের ঢেউ উঠেছে। বদ্ধচিন্তার কারাও হয়তো ক্রমে টুটবে। এবং মাথার উপরে আদালত আছে। ভরসা এইটুকুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy