চার জন শ্রমিকের ম্যানহোলে নামিয়া মৃত্যু যত ভয়ানক, ততই উদ্বেগজনক পুলিশ ও পুরসভার ভূমিকা। কলিকাতা পুরসভারই একটি প্রকল্পের অধীনে জলবাহী নল সারাইবার কাজটি চলিতেছিল। কোন ঠিকাদার ওই শ্রমিকদের নিয়োগ করিয়াছিল, প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক কাহারা, তাহা জানিতে গোয়েন্দা নিয়োগের প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে ওই মৃত্যুগুলির জন্য দোষী কে, তাহা নির্ণয় করা কি এতই কঠিন? এই ঘটনার নৈতিক দায় স্বীকার করিতে হইবে কলিকাতার মেয়রকে। ম্যানহোলে নামিয়া শ্রমিকের মৃত্যু এই শহরে ব্যতিক্রম নহে। কখনও জলে তলাইয়া গিয়া, কখনও বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হইয়া শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ধারাবাহিক ভাবে ঘটিতেছে। আরও অগণিত শ্রমিক প্রাণের ঝুঁকি লইয়া কাজ করিয়াছেন, এবং এখনও করিতেছেন। ভূগর্ভস্থ নালায় কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিধিনিষেধ পালন না করিবার জন্যই এত প্রাণহানি ঘটিতেছে। এই মৃত্যুমিছিল সত্ত্বেও এখনও অবধি পুরসভা এ বিষয়ে নড়িয়া বসে নাই। এমনকি, শ্রমিকমৃত্যুর দায় নির্দিষ্ট করিয়া সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার অথবা আধিকারিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়াছে, এমনও দেখা যায় নাই। অতএব বার বার এই বার্তাই পৌঁছাইয়াছে যে, ক্ষতিপূরণ ধরিয়া দিলেই দরিদ্র শ্রমিকের মৃত্যুর দায় হইতে অব্যাহতি মিলিবে। তাঁহাদের প্রশিক্ষণ না দিয়া, নিরাপত্তা সরঞ্জাম না দিয়া, আপৎকালীন ত্রাণের কোনও ব্যবস্থা না করিয়া কয়েকশো ফুট গভীর গর্তে নামাইয়া দেওয়া চলিবে। এই মনোভাবের কারণেই চার জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং আরও তিন জনের অসুস্থতাকে ‘দুর্ঘটনা’ বলা সম্ভব নহে। তাহা অপরাধ।
শ্রমিকের কল্যাণ ও নিরাপত্তার মান সরকারই বাঁধিয়া দেয়। নজরদারি কড়া হইলে বেসরকারি সংস্থা অথবা গৃহস্থ ব্যক্তিরা তাহাকে অনুসরণ করে, নচেৎ এড়াইতে চাহে। যখন সরকার, অথবা পুরসভা তাহার নিজস্ব কাজে শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধি উপেক্ষা করে, তখন নাগরিক তাহা পালন করিবে, এমন আশা করাই বাতুলতা। অতএব এই শহরে প্রাণের ঝুঁকি স্বীকার না করিলে কাজ মিলিবে না শ্রমিকের। কেহ বহুতল হইতে নীচে পড়িয়া মারা যান, কেহ বিদ্যুতের টাওয়ারে কাজ করিতে গিয়া তড়িদাহত হইয়া, কেহ শ্বাসরুদ্ধ হইয়া প্রাণ হারান। এত সহজে বিধি লঙ্ঘন সম্ভব হয় ‘শ্রমিক’ স্বীকৃতির অভাবে। ঠিকা শ্রমিকের নথিভুক্তির আইনটিও সরকার স্বয়ং উপেক্ষা করে। রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদারের অশুভ আঁতাঁতের ফল, ঠিকাদারের অবাধে শ্রম আইনলঙ্ঘন। ইহার ফলে ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা অথবা নিরাপত্তার ব্যবস্থা, আইনের সব নির্দেশ অর্থহীন বাক্য হইয়া রহিয়া যায়।
শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র, পঙ্গুত্ব এবং প্রাণের মূল্যে যে ব্যবস্থাটি চলিতেছে, তাহা থামাইবে কে? জনপ্রতিনিধিরা অনাগ্রহী, উদাসীন। শ্রমিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলি ঠিকা শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় তৎপর নহে। স্বাধীন দেশে বাস করিয়াও এই শ্রমিকেরা যেন কোনও উপনিবেশের বাসিন্দা। কেবল ব্যবহৃত হইবার জন্যই তাঁহাদের জন্ম। তাঁহাদের জীবনের অধিকারও স্বীকার করে না রাষ্ট্র। এই দরিদ্র মানুষগুলি শুধুই ভোটদাতা, নাগরিক তো নন। আর কতগুলি প্রাণহানির পর হুঁশ ফিরিবে সরকারের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy