ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের পাঁচশো বিজ্ঞানী যে ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বাক্স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করলেন, তা শিক্ষণীয়। বিজ্ঞান গবেষণার ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর (আইআইএসসি) কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে ওই শিক্ষকেরা মনে করালেন, শিক্ষার স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার প্রতি বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি দায়বদ্ধ। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন একাধিক প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী ধারা ‘ইউএপিএ’ নিয়ে একটি আলোচনা সভা, যার আয়োজন করেছিলেন আইআইএসসি-র সেন্টার ফর কন্টিনিউড এডুকেশন-এর ছাত্রছাত্রীরা। বিভাগীয় প্রধান অনুমোদন দেওয়া সত্ত্বেও আলোচনার দিন প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার সভা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ছাত্রছাত্রীরা সভাগৃহের বাইরে আলোচনা শুরু করলে, নিরাপত্তা রক্ষীদের পাঠিয়ে সেই আলোচনাও ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন রেজিস্ট্রার। শিক্ষকদের একাংশ ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলে পিছু হটে রক্ষীরা। কর্তৃপক্ষের এত উদ্বেগ কেন, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। ওই দিন বক্তা হিসাবে ছিলেন দুই তরুণী, নাতাশা নরওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতা— যাঁরা নাগরিকত্ব আইনের (২০১৯) প্রতিবাদ করে জেলে গিয়েছিলেন। ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করে যে ভাবে বহু মানুষকে বিচারহীন অবস্থায় বন্দি করে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার, উন্মুক্ত সভায় তার সমালোচনা হবে, এবং সেই আলোচনা করবেন সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়া বক্তারা— এমন সম্ভাবনায় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা যে থরহরি কম্প হবেন, তাতে সন্দেহ কী? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশের প্রতি কতখানি সদয়, তা দেশবাসী জেনেছেন। কেন্দ্র-পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলিকে যে তারা কী ধরনের আনুগত্যসর্বস্ব, উৎকর্ষবিমুখ প্রতিষ্ঠান করে তুলেছে, তাও বুঝেছেন বিশ্বভারতীর দিকে তাকিয়েই।
আশার কথা এই যে, এমন ‘ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে’ অন্তত কিছু শিক্ষকের বিবেক জাগ্রত রয়েছে। আইআইএসসি কর্তৃপক্ষের প্রতি তাঁদের চিঠিতে ওই পাঁচশো বিজ্ঞানী লিখেছেন, “দৃষ্টিকোণ যা-ই হোক না কেন, গণতন্ত্রকে সচল রাখতে এই ধরনের আলোচনা অত্যন্ত জরুরি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে আইআইএসসি সেই আলোচনার আদর্শ স্থান। অপর পক্ষে, যদি সাংবিধানিক প্রশ্নে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে দিতে এই প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছুক হয়, তা হলে বিজ্ঞানের কাজে উপযু্ক্ত যুক্তিপূর্ণ অনুসন্ধানের মনোভাব কী করে লালনপালন করবে এই প্রতিষ্ঠান, তা বোঝা দুষ্কর।” তাঁদের এই কথাগুলি দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চর্চিত হওয়া দরকার। দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরা, বিশেষত প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা সরকারের নির্দেশ মেনে চলায় যত ব্যগ্র, উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত সংস্কৃতি সুরক্ষার বিষয়ে ততখানিই উদাসীন। সেই সংস্কৃতি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্কৃতির তুলনায় স্বতন্ত্র, স্বকীয়।
বিজ্ঞান থেকে শিল্প, যে কোনও বিষয়ে প্রচলিত মতের বিরোধিতা সক্রিয়, সজীব মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রকাশ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যে রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, বিকল্পের খোঁজ করবেন, সেটা কেবল প্রত্যাশিত নয়, কাঙ্ক্ষিত। অথচ আজ স্বাধীন মতের কণ্ঠরোধ করাই যেন নিয়ম। শিক্ষাবিদ পঙ্কজ চন্দ্র তাঁর বই বিল্ডিং ইউনিভার্সিটিজ় দ্যাট ম্যাটার-এ লিখেছিলেন, ভারতে উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক নেই, রয়েছে কারারক্ষী। নিয়ন্ত্রক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিসর নির্দিষ্ট করে দেয়, তার মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু কারারক্ষী ঠিক করে দেয়, কোন কোন পথ দিয়ে চলা যাবে। নিরাপত্তারক্ষী পাঠিয়ে আলোচনা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা কি কারারক্ষকের শাসনকেই মনে করায় না? যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মুক্ত কারাগারের নামান্তর, সে দেশ কেবল নামেই স্বাধীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy