বাস্তবকে যদি দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে সিনেমার মতো দেখা যেত, বোঝা যেত ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ওয়াশিংটন ডিসি-র দৃশ্যগুলোকে প্রায় পর পর হুবহু দেখিয়ে দিলেই তৈরি হওয়া সম্ভব ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রাসিলিয়ার ছবি। সেই দক্ষিণপন্থী উন্মত্ততার তাণ্ডব, ভাঙচুর, সেই গণতন্ত্র অচল করে দেওয়ার স্লোগান, সেই ভোটের ফল এখনই বাতিল করার দাবি, সেই পরাজিত প্রেসিডেন্টকে জয়ী বলে হুঙ্কার। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর পরোক্ষ উস্কানিতেই এ কাণ্ড ঘটতে পারল, এমনই মনে করার বিস্তর কারণ আছে, ঠিক যেমন দু’বছর আগে আমেরিকায় পরাজিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অঙ্গুলিহেলনেই সংঘটিত হয়েছিল দেশজোড়া তাঁর সমর্থকদের নৈরাজ্যতাণ্ডব। এই দিনের কুনাট্যের পিছনে বোলসোনারোর কতখানি হাত আছে, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার— প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন নিয়মিত ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করার, আইন ভঙ্গ করার একাদিক্রম উদাহরণ দেখিয়ে তিনিই তাঁর দেশকে উন্মার্গগামী দক্ষিণপন্থার সীমানায় ঠেলে দিয়েছেন। ওয়াশিংটন ডিসি এবং ব্রাসিলিয়া, দুই ঘটনার মিল এখানেও পরিষ্কার। গণতন্ত্রের অবক্ষয় এক বার শুরু হলে তা যে কত অদম্য গতিতে নীচের দিকে ধাবিত হতে থাকে, তা এই ঘটনাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। গণতন্ত্রকে পাশ কাটানোর পরবর্তী ধাপটিই তাই গণতন্ত্রের ধ্বংস— এবং এই পরবর্তী ধাপটি এসে পড়ে আশঙ্কার থেকেও অনেক বেশি দ্রুত গতিতে।
আর একটি কথা এ বিষয়ে গুরুতর। ব্রাসিলিয়ার সে দিনের ছবি দেখে যদি কেউ মনে করেন যে, গোটা ব্রাজিল দেশটিই এখন অতিদক্ষিণপন্থীদের খপ্পরে, এবং তাই এমন ঘটনা ঘটতে পারল, সেটা কিন্তু বিরাট ভুল হবে। বাস্তবিক, দেশটি এই মুহূর্তে অন্তত আধাআধি বিভক্ত হয়ে আছে গণতন্ত্রবাদী ও দক্ষিণপন্থী অ-গণতন্ত্রবাদীদের মধ্যে— ‘অন্তত’ শব্দটি এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। মনে রাখা ভাল, মাসাধিক কাল আগেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই বোলসোনারোকেই ভোটে হারাতে পেরেছেন লুলা দা সিলভা। অর্থাৎ? অর্থাৎ, দেশের কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি শীর্ষ ভবনগুলির উপর ভয়ানক নৈরাজ্যের এই বিকৃত ছবিটি চোখের সামনে নির্মিত হওয়ার জন্য বেশি কিছু দরকার হয় না— দেশের একাংশ গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী হলেই চলে। ভাঙনের জোর যে কত বেশি, কত তাড়াতাড়ি তা গণতন্ত্রে ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে, এর থেকে সে কথা স্পষ্ট হয়। স্মরণ রাখতে হয় যে, সেই জন্যই গণতান্ত্রিক দেশে ভাঙনের পূর্বাভাস দেখলেই উদ্বেগ এবং উদ্বেগজনিত সক্রিয়তা জরুরি।
ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুলা কত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেন, কী ভাবে অনাচারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, তার উপর তাঁর দেশের স্থিতিশীলতা ও দেশবাসীর নিরাপত্তা নির্ভর করছে। আশা রইল, বোলসোনারো অন্তত কিছুটা রাজনীতিবোধ দেখিয়ে নিজের নির্বাচনী পরাজয় মেনে নিতে পারবেন, এবং তাঁর সমর্থকদের শান্ত করতে পারবেন। নতুবা ব্রাজিল এক অনন্ত সংঘর্ষসাগরে নিমজ্জিত হতে বসবে— সে দিনের নৈরাজ্যকারীরা ঠিক যা চাইছিলেন।