রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।
লোকসভায় যে দিন অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল, অথবা আলোচনার তারিখ স্থির হয়েছিল যে দিন, তখনও রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ নিলম্বিত। সুপ্রিম কোর্ট আইনসভায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের পথ করে দিয়েছে। বিরোধী রাজনীতির— এবং, সামগ্রিক ভাবে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের— পরিসরে রাহুল গান্ধী এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। শাসকপক্ষ যে ভঙ্গিতে তাঁকে সভা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে, সেটাই তাঁর গুরুত্বের অন্যতম সূচক। রাহুলের বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা হয়েছিল, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দু’বছরের কারাদণ্ড, এবং লোকসভার সদস্যপদ খারিজ হতে ন্যূনতম কারাদণ্ডের মেয়াদও ঠিক তত দিনই। সুরাত জেলা আদালতের মাননীয় বিচারক কেন রাহুল গান্ধীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তিই বরাদ্দ করেছিলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি বলেই সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ। শাস্তির মেয়াদ কোন যুক্তিতে নির্ধারিত হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে এই নিবন্ধে জল্পনা অনাবশ্যক। তবে, যে কোনও প্রকারে বিরোধী রাজনীতিকে ঠেকিয়ে রাখার যে অত্যুগ্র তাড়না শাসকদের আচরণে প্রকট, জেলা আদালতের রায় ও গুজরাত হাই কোর্টের তাকে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত তার পক্ষে অনুকূল ছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় একটি কথা স্পষ্ট করে দিল: সংবিধান বা আদালতকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা চলবে না। ভারতের বর্তমান শাসকরা সুশিক্ষা গ্রহণ করেন, এমন উদাহরণ গত ন’বছরে সুলভ নয়। তবুও আশা, শীর্ষ আদালতের অবস্থানটি তাঁদের কিছুটা হলেও ভাবতে বাধ্য করবে।
রাহুল গান্ধীর সংসদে প্রত্যাবর্তন, অতএব, কেবলমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত বা দলগত বিষয় নয়— গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার যে অসম যুদ্ধ দেশে চলছে, এক অর্থে এই প্রত্যাবর্তন তার একটি জয়ের স্মারক। ফলে, রাহুলের দায়িত্বও কেবলমাত্র তাঁর দলের প্রতি নয়, গণতন্ত্রের প্রতি। সাম্প্রতিক অতীতে তিনি একাধিক বার প্রমাণ করেছেন যে, রাজনৈতিক ভাবে তিনি পরিণতমনস্ক হয়েছেন। তাঁর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র রাজনৈতিক অভিঘাত অনস্বীকার্য। কিন্তু, সেটুকুই যথেষ্ট নয়। ‘ঘৃণার বদলে ভালবাসা’, তাঁর এই অবস্থানটিই দাবি করে যে, তাঁকে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। শুধু এই কারণে নয় যে, শাসকদের পক্ষে সেই ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করা দৃশ্যত দুঃসাধ্য, অথবা অসম্ভব; এই কারণেও বটে যে, গণতন্ত্রের পরিসরটির যে ক্ষতি গত এক দশকে হয়েছে, তা মেরামত করার কাজটি অবিলম্বে শুরু করা দরকার। রাজনীতির কোন রূপ গণতন্ত্র দাবি করে, রাহুল তা জানেন বলেই আশা করা চলে। নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার তুল্য নেতৃত্বের আর কোনও প্রকাশ নেই।
এই প্রত্যাশা থেকে যদি লোকসভায় অনাস্থা বিতর্কে রাহুলের ভাষণটিকে শোনা যায়, তা হলে কিঞ্চিৎ হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। তিনি যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলির সত্যাসত্য যাচাই নিশ্চয়ই করা যেতে পারে, কিন্তু তা মূল কথা নয়। প্রথমত, তিনি ব্যক্তি-আক্রমণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না। তা শুধু দৃষ্টান্তস্থাপনে ব্যর্থতা নয়, কৌশলগত ভুলও বটে— তাঁর জানা উচিত ছিল, অসৌজন্যের খেলায় তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন। অতএব, খেলাটি পরিত্যাজ্য। দ্বিতীয়ত, গত এক বছরে তিনি ভারতের পথে হেঁটেছেন, মানুষের কথা শুনেছেন; তিনি অগ্নিগর্ভ মণিপুরে গিয়ে দেখা করেছেন আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে। ভারতমাতার ক্লান্ত রূপক অথবা রামায়ণের জীর্ণ প্রসঙ্গ নয়, বিরোধী নেতার কর্তব্য ছিল, তিনি মানুষের যে বিপন্নতার কথা শুনেছেন, দেশের সর্বোচ্চ কক্ষে তা পেশ করা। সরকারকে সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে বাধ্য করা। এই অনাস্থা বিতর্ক তাঁকে সেই সুযোগটিই করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রে বিরোধী নেতার ভূমিকা বিপুল; শাসক যদি গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ না হয়, তবে সেই ভূমিকা বিপুলতর। শাসককে গণতন্ত্রের পথে থাকতে বাধ্য করা বিরোধীর কাজ। ক্ষুদ্রতা বর্জন করে রাহুল সেই গুরুদায়িত্বে মনোনিবেশ করুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy