‘ডেলিভারি পার্টনার’-দের একাংশ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন, কারণ সংস্থাটি আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ডেলিভারি বাবদ মজুরির কাঠামো পরিবর্তনের জন্য। প্রতীকী ছবি।
কয়েক সপ্তাহ আগে কলকাতায় একটা ছোটখাটো বিদ্রোহ হল। এক কুইক কমার্স সংস্থার ‘ডেলিভারি পার্টনার’-দের একাংশ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন, কারণ সংস্থাটি কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ডেলিভারি বাবদ মজুরির কাঠামো পরিবর্তন করে, ফলে ডেলিভারি-প্রতি মজুরির পরিমাণ কমে যায় চল্লিশ শতাংশ। স্বাভাবিক যুক্তি বলবে যে, মজুরির হার বাজারের চাহিদা-জোগানের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হওয়াই কাম্য— যদি চল্লিশ শতাংশ কম মজুরিতেই কর্মীরা কাজটি করতে সম্মত হন, তবে সেই মজুরিই ন্যায্য। বাজারের ধর্মের প্রতি অবিচলিত থাকাই প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধনতন্ত্রকে কালজয়ী করেছে। কিন্তু, শুধু এটুকু বললে কথাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে যে ‘প্ল্যাটফর্ম ইকনমি’-র প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, তা সর্বার্থে মুক্ত বাজারের দর্শনের অনুসারী নয়। প্রথম আপত্তি উঠতে পারে ‘ডেলিভারি পার্টনার’ শব্দটিতেই। ‘কর্মী’ পরিচয় দিলে শ্রম-আইনের নিগড়ে বাধা পড়তে হবে, সেই আশঙ্কায় ডেলিভারি কর্মীদের ‘পার্টনার’ বা ‘অংশীদার’ বললে শুনতে ভাল লাগে বটে, কিন্তু কর্মীদের স্বার্থহানি হয়। তার প্রধানতম কারণ, এ-হেন সংস্থার শ্রম-প্রক্রিয়ায় এই তথাকথিত ‘পার্টনার’দের তিলমাত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে না, এবং সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত অংশীদারি হয় না। ধনতন্ত্রের যুক্তি বলবে, কর্মীদের যা প্রকৃত প্রাপ্য, সেই স্বার্থরক্ষার দায়িত্বটিও পুঁজির উপরেই বর্তায়। সেই দায়িত্ব অস্বীকার করে বাজারের দোহাই দেওয়া চলে না। দুনিয়া জুড়েই ‘গিগ ইকনমি’ একটি বিচিত্র ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে— বৃহৎ সংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যেই তৈরি হয়েছে এক অসংগঠিত ক্ষেত্র। এই ব্যবস্থা প্রকৃত উন্নয়নের স্বার্থবিরোধী।
ঊনবিংশ অথবা বিংশ শতাব্দীতে এমন পরিস্থিতিতে আলোচিত হত শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্বের কথা। সেই ব্যবস্থার অকুশলী এবং অপচয়ী রূপ বিশ্ব দেখেছে— পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, অপরিণামদর্শী শ্রমিক সংগঠন রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যতের কী সর্বনাশ করতে পারে। অতএব, সেই পথ পরিত্যাজ্য। প্রকৃত উত্তরণের পথ নিহিত আছে উদারবাদী ধনতন্ত্রের যুক্তিতেই, যা প্রত্যেককে তাঁর ব্যক্তি-সামর্থ্যের সীমা অবধি বিকাশের সুযোগ করে দিতে পারে। ‘গিগ অর্থনীতি’ শ্রমকে নমনীয় করেছে— কেউ যদি চান, তবে তিনি আরও বেশি সময় কাজ করে নিজের আয় বাড়াতেই পারেন। কিন্তু, নিতান্ত দু’বেলার অন্ন সংস্থান করার জন্য কোনও শ্রমিককে দিনে চোদ্দো ঘণ্টা কাজ করতে হবে, এমন ব্যবস্থা সেই বিকাশের পথে বাধা। ‘গিগ অর্থনীতি’-র পরিচালকদের বুঝতে হবে যে, অন্যায্য বঞ্চনা দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃত সহযোগিতার পরিসরটিকে ধ্বংস করে। অতএব, শ্রমিকের যা ‘প্রাপ্য’, বিনা অজুহাতে তা প্রদান করতে হবে। তার মধ্যে যেমন মজুরি আছে, তেমনই আছে ছুটির অধিকারও। ন্যায্য ‘প্রাপ্য’ কতখানি, তা স্থির করার জন্য শুধু চাহিদা-জোগানের সমীকরণ দেখলে চলবে না— একটি ন্যূনতম মজুরির হার স্থির করে নিতে হবে নিজেদেরই।
এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। প্ল্যাটফর্ম সংস্থাগুলি শ্রমিকদের কী হারে মজুরি দেবে, কত ক্ষণ কাজ করাবে, তা বেঁধে দেওয়া সরকারের কাজ নয়। কিন্তু, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্বটি বিলক্ষণ সরকারের। প্রথমত, এই নতুন গোত্রের কর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে স্বীকার করা, এবং শ্রমবিধিতে তাঁদের কথা স্মরণে রাখা জরুরি। প্রথাগত কারখানা বা দফতরের সঙ্গে ‘গিগ অর্থনীতি’র ফারাক দুস্তর, এবং প্রথম গোত্রের কর্মস্থলের কথা ভেবে শ্রমবিধি রচনা করলে গিগ অর্থনীতির কর্মীদের প্রয়োজন মিটবে না। সম্প্রতি রাজস্থান সরকার গিগ কর্মীদের জন্য একটি তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করল— সংস্থাগুলির থেকে তাদের প্রতিটি ‘গিগ ওয়ার্ক’-এর পিছনে ব্যয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘লেভি’ হিসাবে আদায় করা হবে, এবং সেই তহবিলের টাকায় গিগ কর্মীদের জন্য বিমা, ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা হবে। ভারতে সামাজিক সুরক্ষার কাঠামো কমজোরি। বিশেষত, যাঁদের কাজের চরিত্র অসংগঠিত ক্ষেত্রের তুল্য, তাঁদের ক্ষেত্রে সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যত নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় এই গোত্রের তহবিল তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। গিগ কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করা যায় কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে। মোট কথা, মনে রাখতে হবে যে, অন্যায্য শর্তে কর্মী নিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে সমগ্র অর্থব্যবস্থার জন্যই ক্ষতিকর। সাময়িক লাভের লোভে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পথে হাঁটা ধনতন্ত্রের স্বধর্ম নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy