রাহুল গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী কি রাহুল গান্ধীকে ভয় পাচ্ছেন? কংগ্রেসের ‘খারিজ’ সাংসদের নতুন ভাবমূর্তির সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ার গভীরতর ভয়? ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সময় থেকেই এই প্রশ্ন বাতাসে ভাসমান, কিন্তু আদালতের— গুজরাতের আদালতের— রায়ের সূত্র ধরে রাতারাতি রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পরে বিরোধী শিবিরের সমস্বর প্রতিবাদ ভয়ের প্রশ্নটিকে বিপুল আকার দিয়েছে। প্রতিবাদ কতটা স্থায়ী হবে, বিরোধিতার এই মাত্রা কত দিন বজায় থাকবে, কারও জানা নেই; কিন্তু এই প্রতিস্পর্ধা কেবল প্রতিবাদীদের সংখ্যা গণনার ব্যাপার নয়, তার একটি বৃহত্তর মাত্রা আছে। নীতিগত মাত্রা। শাসক দল হয়তো নীতি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না, কিন্তু ভোট নিয়ে তাদের, অন্তত এখনও, মাথা ঘামাতে হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিসরে রাহুল গান্ধী যে ‘নৈতিক উচ্চভূমি’ অর্জন করে নিয়েছেন, ভোটের রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে। বস্তুত, প্রায় ন’বছরের মোদী জমানায় বিরোধী দলগুলি কার্যত এই প্রথম নিজেদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এক পাশে সরিয়ে রেখে শাসকের অনাচারের নিন্দায় সমবেত হয়েছে। এই সমস্বরের ভিত্তিতে আছে এক নৈতিক সংহতি। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সতীর্থ তথা অনুগামীরা তার গুরুত্ব বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। বুঝতে পারছেন বলেই তাঁদের উদ্বেগ এবং ক্রোধ এতখানি প্রকট।
বিরোধী শিবিরের নেতারা সেই গুরুত্ব কতটা বুঝতে পারছেন? এক দিকে সাঙাততন্ত্রের অভিযোগ, অন্য দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সমস্ত বিরোধিতা দমনের অভিযোগ— এই দ্বৈত আক্রমণের নীতিগত অভিঘাত যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তার পিছনে রাহুল গান্ধীর লাগাতার সরব ও সক্রিয় ভূমিকার অবদান আক্ষরিক অর্থেই অ-তুলনীয়। বিরোধী (বা তথাকথিত বিরোধী) শিবিরের নেতা ও নেত্রীরা এই সত্যকে স্বীকার করতে পারলে তাঁদের সমন্বয় ও সংহতির এক নতুন সম্ভাবনা প্রবল, যে সম্ভাবনা গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে জরুরি। শাসকের যে অসহিষ্ণু একাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এই সম্মিলিত প্রতিস্পর্ধা, তাকে প্রতিহত করতে না পারলে এ দেশে যথার্থ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎই সংশয়াচ্ছন্ন। বিভিন্ন দলের পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত অবাস্তব নয়, তার নানা হেতুও আছে, কিন্তু পায়ের নীচ থেকে গণতন্ত্র নামক জমিটিই যদি সরে যায়, তা হলে সেই সব সংঘাতের কতটুকু মূল্য অবশিষ্ট থাকবে, আপন আপন অহঙ্কারের প্রতি মনোযোগী বিরোধী নেতারা সে কথা হয়তো এ বার— রাহুল গান্ধীর অভিজ্ঞতা লক্ষ করে— ভেবে দেখছেন।
তার অর্থ এই নয় যে, রাহুল গান্ধীকেই বিরোধী শিবিরের ‘নায়ক’ বলে মেনে নিতে হবে বা তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী পদের প্রতিস্পর্ধী দাবিদার হিসাবে সামনে রেখে বিরোধী শিবিরকে নির্বাচনী ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়, অনেক বিরোধী দলই এমন অবস্থান নিতে পারবে না— রাজ্য রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই হোক, স্বাভিমানের কারণেই হোক। কংগ্রেসকেও কিন্তু এই সত্য বুঝতে হবে এবং নানা বাধা ও অপূর্ণতাবোধ পেরিয়ে গিয়ে কথাটা মানতে হবে। বস্তুত, তেমন ব্যক্তিগত ‘দ্বৈরথ’-এর কোনও প্রয়োজনও নেই। ঘটনা হল, রাহুল গান্ধীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে ও আচরণে যে নৈতিক অবস্থানের পরিচয় আছে, ব্যক্তি-নায়ক রাহুল গান্ধীর থেকে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। শাসক শিবিরের ব্যক্তি-সর্বস্ব রাজনীতির প্রকৃত বিকল্প হতে পারে সেই নৈতিকতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক সংহতি। চওড়া ছাতির জবাবে চওড়াতর ছাতি নয়, গণতন্ত্রকে ছাতির মাপ থেকে উদ্ধার করে উদার বহুমতের নৈতিক পরিসরে ফিরিয়ে আনার উদ্যমটিই হতে পারে মোদীতন্ত্রের মুখের উপর প্রকৃত জবাব। ইতিহাসের লীলায় রাহুল গান্ধী এই ভারতে সেই উদ্যমের অনুঘটক হয়ে উঠেছেন। বাকি ইতিহাস নির্ভর করবে বিরোধী শিবিরের সুচিন্তা ও সুবিবেচনার উপর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy